|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
|
তাহাদের কথা
আর্কলাইট তৈরিতে সাহায্য করেন ওঁরা। আর্কলাইট কখনও ওঁদের ওপর পড়ে না।
টলিউডের তেমনই কয়েক জন কলাকুশলীর কথা শুনলেন পরিচালক সুমন ঘোষ |
|
|
রিনা মণ্ডল
(হেয়ারস্টাইলিস্ট)
‘আবহমান’-এর কাজ নিয়ে অনেকেই আমার প্রশংসা করেছিলেন
১৯৮০ সালে আমার বাবা মিসিং হন। তখন বাড়িতে অন্ন সঞ্চয় কী করে হবে সেই ভাবনা নিয়ে আমাদের খুব খারাপ সময় কাটত। আমরা চার বোন, দু’ভাই। আমার মা রঙমহল থিয়েটারে ড্রেসার হয়ে ঢুকলেন। আমি তখন খুব ছোট। মায়ের সঙ্গে যেতাম এবং সেখান থেকেই আমার কাজ শেখা। রীতা দে, যিনি অপর্ণা সেনের হেয়ারড্রেসার ছিলেন, আমাকে খুব সাহায্য করেন। রঙমহলে তখন আমি মিস শেফালি, অপর্ণা সেন, সুব্রতা, শ্রীলা মজুমদার, বাসবী নন্দী এঁদের সঙ্গে থিয়েটারে কাজ করি। মিস শেফালি আমার মায়ের মতো ছিলেন। কত কিছু যে আমাকে শিখিয়েছেন এই লাইন নিয়ে!
আমি চারশোটার মতো ছবি করে ফেলেছি এই ইন্ডাস্ট্রিতে। ইন্দ্রাণী হালদার আর রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ফিল্মের কাজ আমাকে সব থেকে বেশি শিখিয়েছে। আমার মনে আছে, ইন্দ্রাণী আমাকে রীতিমতো থ্রেট দিত। ম্যাগাজিন থেকে একটা হেয়ারস্টাইল আমার সামনে রেখে বলত, “আমার এটা চাই।” সেটা আমাকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলত।
সব থেকে তৃপ্তি পেয়েছি ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) সঙ্গে কাজ করে। প্রধানত ‘চোখের বালি’তে আমার মনে আছে যে, আমি রাইমা সেনের হেয়ারস্টাইলটা করেছিলাম। আর ঐশ্বর্যারটা করেছিল ওঁর নিজের হেয়ারস্টাইলিস্ট। ছবিটা রিলিজ করার পর অনেকে রাইমাকে আরও প্রশংসা করে... সেটা যে আমাকে কী তৃপ্তি দিয়েছিল। সেরকম ‘আবহমান’-এ অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের জন্য আমার কাজ নিয়েও আমাকে অনেকে প্রশংসা করেন। দেখুন, আমরা থাকি নেপথ্যে। কোনও পুরস্কারও আমাদের দেওয়া হয় না। কেউ আমাদের কাজ মনেও রাখে না। তাই এগুলোই খুব তৃপ্তি দেয়। |
|
হারু বর্মন
(প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট)
আমার তৈরি চিকেন স্টু দেবের খুব পছন্দ
আমি ১৯৯৬-এ ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিই। তার আগে একটা গ্লাভসের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। গ্লাভসের ফ্যাক্টরিতে থাকাকালীন খুব হাতের অসুখ হত। তাই সেই চাকরি ছেড়ে একটা ক্যুরিয়রের চাকরিতে জয়েন করি। একশোটা চিঠির বেশি চিঠি ডেলিভারি করলে প্রতি চিঠির জন্য পঁচিশ পয়সা কমিশন পেতাম। তার পর সেটা ছেড়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আমি চা বানাতাম।
এখন তো রান্না করি, খাবারদাবারের সব ব্যবস্থাপনা করি। ধরুন আউটডোরে গিয়েছি, আশেপাশে কোনও দোকানপাট নেই। খুব সকালে কলটাইম। আগের দিন রাত থেকে টেনশন শুরু হয়। সবাইকে খুশি করতে পারব তো? সকলের খাবার ঠিক সময়েই পৌঁছে দিতে পারব তো?
দেব খুব ‘ক্যাজুয়াল’ ছেলে। এত বড় স্টার কিন্তু খুব সুন্দর ব্যবহার। ওর তো নিজের শরীর মেনটেন করতে হয়। তাই ধরুন অনেক রকম রেস্ট্রিকশন আছে খাবারদাবারের প্রতি। আমার সেটার দিকে নজর থাকে। ও আমার হাতের তৈরি চিকেন স্টু খুব ভালবাসে।
যেদিন হারাধনজেঠু মারা যান সেটাই আমার জীবনে সব থেকে দুঃখের দিন। উনি আমাদের ছেলের মতো ভালবাসতেন। আর খুব ভালমানুষও ছিলেন। ওঁর শ্রাদ্ধতেও আমাকে ডেকেছিলেন জেঠিমা। আমি যাইনি। আমি অত কষ্ট নিতে পারতাম না।
বুম্বাদা আউটডোরে গেলে আমাদের কোনও টেনশন থাকে না। জানি উনি সব ম্যানেজ করে নেবেন। প্রত্যেকের জন্য খুব ভাবেন। এই ধরুন যখন ইজিপ্ট গিয়েছিলাম ‘মিশর রহস্য’ করতে উনি আমাদের সব টেকনিশিয়ানকে একশো পাউন্ড দিলেন নিজে থেকে। বললেন, খরচ করতে। এটা কে করবে বলুন তো? তবে আমি চাইব আমার ছেলেমেয়ে যেন এই লাইনে না আসে। অনেক মানুষ এই লাইনটাকে নিচু চোখে দেখে। |
|
তাপস সেন
(ইলেকট্রিশিয়ান)
কেউ যেন না বলে আমি লাইটটা বুঝি না
আমি ১৯৯৪ সালে ইন্ডাস্ট্রিতে আসি। আমার বাবা ছিলেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। সেই সূত্রেই আসি। ‘তিতলি’ ছবিতে আমি প্রথম কাজ করি। অভীক মুখোপাধ্যায় আমার গুরু। ওঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তা ছাড়া আমি পিসি শ্রীরাম, অশোক মেহতা, বরুণ মুখোপাধ্যায় এঁদের মতো বাঘা বাঘা ক্যামেরাম্যানদের সঙ্গে কাজ করেছি।
আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে সব চেয়ে আনন্দের মুহূর্ত যখন ‘বান্টি অউর বাবলি’তে আমি অমিতাভ বচ্চনের সামনে লাইট করেছিলাম। সে অভিজ্ঞতা আমি জীবনে ভুলব না।
আমার কাছে আমার কাজটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব সময় ভাবি কেউ যেন না বলতে পারে আমি লাইটটা বুঝি না। সব সময় শেখার চেষ্টা করি।
আমি চাইব আমার ছেলেরা যেন টেকনিশিয়ান না হয়। ওরা ভাল চাকরি করুক এটাই চাই। |
|
শান্তনু পাল
(ফাইট মাস্টার)
‘পুরুষোত্তম’ ছবির মতো স্টান্ট খুব কম বাংলা ছবিতেই হয়েছে
আমি মার্শাল আর্টসের ট্রেনিং নিয়েছিলাম সত্তরের গোড়ার দিকে। তার পর ১৯৭৩-এ আমরা অনেকে পালিয়ে মুম্বই চলে যাই। তখন আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা তো জানেন। আমাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন যাঁরা এখন হিন্দি ছবির বিখ্যাত পরিচালক। তাঁদের এখন নাম নেওয়া যাবে না। যাই হোক, মুম্বইতে মনসুর আহমেদ তখন ফাইটমাস্টারের কাজ করতেন। উনি মেদিনীপুরের লোক। উনি আমায় এই কাজটা শেখান। প্রথমে স্টান্টম্যানের কাজ করতাম। তার পর হলাম চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাইটমাস্টার। ফাইট মাস্টার হতে গেলে ক্যামেরা এবং এডিটিং সেন্স থাকা দরকার। সেটা বুঝতাম। তাই অফটাইমে আমি ক্যামেরাম্যানদের বাড়ি গিয়ে কাজ শিখতাম। ১৯৮৫ সালে কলকাতায় ফিরলাম, এখানে কাজ করব বলে। প্রথমে সবাই ভাবত বাঙালি ছেলে অ্যাকশন করতে পারবে না। আমাদের মুম্বইয়ের ফাইটমাস্টারদের সঙ্গে কমপিট করতে হত। আমাদের খুব বাজে ভাবে ট্রিট করা হত। চাইলে জলও দেওয়া হত না। আর ওরা খেত মিনারেল ওয়াটার। তবে অঞ্জন চৌধুরী, হরনাথ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকেরা আমাকে প্রথম সুযোগ দিলেন। ‘শত্রু’তে আমি পুরো ফাইটসিনগুলো ডেভলপ করি। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুরুষোত্তম’ ছবিতে আমি স্টান্ট ডিরেক্টর ছিলাম। গর্ব করে বলতে পারি ওরকম স্টান্ট বাংলা ছবিতে এখনও হয়নি।
একটা দুঃখের ঘটনা বলি হরনাথ চক্রবর্তীর ‘প্রতিবাদ’ ছবি চলছে। ফাইট সিকোয়েন্সগুলোর সময় ইন্ডাস্ট্রিতে ধর্মঘট হয়। ঠিক করা হল চেন্নাইতে শ্যুট হবে। সেই ছবিতে গাড়ি ওড়ানোর ব্যাপার ছিল। কলকাতায় সেই সব করার অনুমতি দেওয়া হল না। যদিও আমি পুরো ফাইট সিকোয়েন্সটা ডিজাইন করেছিলাম, কিন্তু চেন্নাইয়ের এখানকার লোকেরা জোর জবরদস্তি আমাদের কাজ করতে দিল না। ছবিটা রিলিজের সময় দেখি আমার নাম নেই। ফাইট মাস্টার হিসেবে জুডো রামুর নাম। এবং সেই থেকেই শুরু হল ওদের দিয়ে কাজ করানো। এখনও যা চলছে। ফাইটগুলো ওখানকার ছবি থেকে জাস্ট কপি করা হয়। সেটা আমি করতে পারব না।
এত নায়কের সঙ্গে কাজ করার পর বলছি প্রসেনজিতের সঙ্গে কাজ করাই সব চেয়ে মজার। খুব ভার্সেটাইল। এবং উনি ফাইট করার সময় ইমোশনাল অ্যাক্টিংটাও দারুণ করেন। আর এত বড় স্টার হয়েও খুব সিনসিয়ার। যদিও অন্যরাও ভাল... |
|
বিরজু লাল
(ড্রেসার)
একটাই টার্গেট, আমার জন্য যেন শ্যুট আটকে না যায়
আমার কাজটা হচ্ছে আর্টিস্টদের জন্য পোশাক জোগাড় করা। পরিচালকের প্রয়োজন অনুযায়ী কসটিউম ডিজাইনার আমাকে ড্রেস জোগাড় করতে বলেন। কিন্তু সেখানে অনেক চাপ থাকে। ‘কন্টিনিউটি’ বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় নানা সমস্যাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমার একটাই টার্গেট থাকে আমার জন্য শ্যুট যেন আটকে না যায়।
আমার আর্ট ফিল্মের কাজ করতে আরও ভাল লাগে। অনেক কিছু জানা যায়। সেগুলো করে একটা তৃপ্তি পাই। এক জন আমায় খুব ভালবাসেন। তিনি পরিচালক গৌতম ঘোষের স্ত্রী খুকুদি। ‘শূন্য অঙ্ক’-এর প্রিমিয়ারের দিন বড় বড় লোকজনের সামনে আমাকে স্টেজে ওঠালেন। আমাদের ওইটুকুই তৃপ্তি।
একটা মজার ঘটনা বলি। এই তোমার ‘নোবেল চোর’-এর শ্যুটের সময়। আমি যে হাওয়াই চটিটা মিঠুনদার জন্য নিয়ে আসি, সেটা তোমার পছন্দ হয়নি। আমি দৌড়ে বাজারে চলে গেলাম অন্য চটি কিনতে। কিন্তু নতুন চটিতে তো হবে না। কেননা মিঠুনদার চরিত্রটা গ্রামের চাষার। তাই পুরোনো দেখতে হতেই হবে। আমি একটা চটির দোকানে গেলাম রাস্তার পারে। যে বিক্রি করছিল তার চটিটা একদম ঠিক লাগল। আমি ওকে বললাম আমার ওই চটিটা চাই। সে তো অবাক! আমি নতুন চটির দাম দিয়ে কেন ওর ওই পুরোনো চটিটা কিনছি!
যাকগে... কিনে এনে যখন মিঠুনদাকে পরালাম, উনি তখনই জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এনেছি। আমি বললাম নতুন চটি কিনে ওটাকে ওয়েদার করলাম। পুরো মিথ্যে কথা। মিঠুনদা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যি?” আমি মিঠুনদাকে বললাম “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না?”
যাই হোক তুমিও খুশি হলে। আর দারুণ শ্যুট হল। পরে অপুদাই (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) গল্পটা মিঠুনদাকে বলে দিলেন। মিঠুনদা আমায় ডেকে কী গালাগাল (মজা করে)। ওই মানুষটা আমায় খুব ভালবাসেন। কোথায় এত বড় সুপারস্টার!
এই রকমই হাসিঠাট্টার মধ্যে ভালভাবে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করি। |
|
|
|
|
|
|