পালকি করে গঙ্গাস্নান এখন অতীত। অন্দরমহল ও বাহিরমহলের দূরত্বও ঘুচেছে অনেক দিন। শহর হয়ত সত্যিই বদলেছে। কিন্তু গ্রাম? কেমন আছেন গ্রামের কর্মরত মহিলারা?
হুগলির আরামবাগ ব্লক অফিস। গোটা অফিসে মহিলা কর্মী একজনই। গ্রাম সেবিকা হৈমশ্রী মাজি।
কর্মস্থলে আর কোনও মহিলা না থাকার কারণে অবসর সময়ে বাকি সহকর্মীরা যখন গল্পে মশগুল, তখন একাই থাকতে হয় তাঁকে। তাঁর অভিযোগ, “স্বর্ণ জয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা প্রকল্পের পুরুষ দলগুলির সদস্যেরা আমার ডাকা আলোচনাগুলিতে আসতে চান না। হয় তো আমি মহিলা বলেই তাঁদের এই আচরণ।”
হুগলিরই সিঙ্গুর ব্লকের নারী উন্নয়ন আধিকারিক ইলা সমাদ্দার বলেন, “কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যার মুখে পড়তেই হয়। তবে সেটা মানিয়ে নিতে হয়। অশোভন আচরণের সামনে এখনও পড়তে হয়নি।” একই মত ডোমজুড়ের ব্লক অফিসের এক মহিলা কর্মীর।
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের বিভিন্ন সরকারি দফতরের মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার পরে উঠে এল বেশ কিছু তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু মহিলা সরকারি কর্মী জানালেন, অনেক অফিসেই পুরুষ ও মহিলা শৌচাগার পাশাপাশি থাকায় সমস্যা হয়। তাঁদের দাবি, দফতরের মহিলা কর্মীদের কথা শোনার জন্য সব দফতরেই একজন মহিলা আধিকারিক থাকার দরকার।
উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সচিব পাপিয়া চৌধুরী ও বনগাঁর স্কুল শিক্ষিকা পদ্মাবতী মণ্ডল ঘোষ জানালেন, বাড়ি থেকে কর্মস্থলের বেশি দূরত্বের কারণে পরিবারকে সময় দিতে সমস্যা হয়।
অথচ, অফিস সামলেও পরিবারের নিজস্ব চাহিদা তো বাড়ির মেয়েদেরই সামলাতেই হয়।
কর্মস্থলে যাওয়ার সময়ে ট্রেনে-বাসে মহিলাদের নিরাপত্তা নেই বলেও জানালেন কর্মরত বহু মহিলা। কাকদ্বীপের স্কুল শিক্ষিকা, মথুরাপুর পঞ্চায়েত সমিতি কিংবা ডায়মন্ড হারবারের সরকারি অফিসের মহিলা কর্মীদের কথায় উঠে এল সেই সমস্যার কথা। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য মহিলা ট্রেনের মত মহিলা বাসের দাবিও জানালেন কেউ কেউ।
অঙ্গনওয়াড়ি কিংবা আশা কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া গেল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হাওড়ার মাকড়দহের অঙ্গনওয়ারী কর্মী সবিতা দাস বলেন, “সংসারে কিছু টাকা দেওয়া ও বাইরের জগতকে জানার জন্যই আমি চাকরিতে যোগ দিয়েছি। বাইরের জগতের নিজস্ব কিছু সুবিধা-অসুবিধা তো থাকবেই।”
বসিরহাট মহকুমার প্রায় ১৫০০ হাজার ইটভাঁটার প্রতিটিতে গড়ে ৫০ জন করে মহিলা কাজ করে। ইটভাটার কর্মী কামিনীবালা মণ্ডল, সফিরা বিবিরা জানালেন, “মালিক অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তব অন্য। বেশিরভাগ ইটভাটাতে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা কোনও শৌচাগার নেই।”
এ ব্যাপারে যদিও ইটভাঁটার মালিকপক্ষের দাবি, প্রায় প্রতিটি ইটভাটাতেই মহিলাদের জন্য আলাদা শৌচাগার রয়েছে।
হুগলির বাসিন্দা, অভিনেত্রী লোপামুদ্রা সিংহের মতে, রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব বাড়ছে। তবে, এ ক্ষেত্রে শুধু প্রশাসন নয়, সচেতন হতে হবে অভিভাবকদেরও।
তাঁর কথায়, “সমস্যা অনেক। কিন্তু লড়াই করলে সমাধান সম্ভব। শূন্য থেকেই শুরু হোক।”
সেই লড়াইয়ের কথাই শোনালেন মাকড়দহের আশা কর্মী সোনালি শ্রীমানি। দিনের পর দিন প্রায় বিনা বেতনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পোলিও খাওয়ানোর কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, “বাচ্চাকে পোলিও খাওয়াবে না বলে অনেক পরিবারের সদস্যেরা মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। মহিলা হয়েও আমরা হাল ছাড়িনি। বুঝিয়েছি। সেই পরিবারগুলির সদস্যরা এখন নিজে এসে পোলিও খাইয়ে যায়। এটাই আমার কাজের পারিশ্রমিক।”
পুরুষের থেকে কোনও অংশে পরিশ্রমে আপত্তি নেই মহিলা কর্মীদের। শুধু প্রয়োজনীয় সম্মান ও পরিকাঠামোটুকুই তাঁদের দাবি।
|
তথ্য সূত্র: পীযূষ নন্দী, প্রকাশ পাল, নির্মল বসু, সীমান্ত মৈত্র, দিলীপ নস্কর, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। |