|
|
|
|
‘নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজেকে সম্মান করতে হবে’ |
খাটো শরীরে লড়েই আজ মাথা উঁচু |
তুহিনকণা নাজির |
তখন আমি খুবই ছোট। এগরার বৈঁচা গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আকলাবাদ প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। সেই স্কুলে সহপাঠীদের বিদ্রুপেই প্রথম টের পেলাম নিজের শারীরিক ত্রুটি। জন্মের পর আমার শরীরের বৃদ্ধি হয়নি। পা দুটো বাঁকা। যেদিন সহপাঠীরা ব্যঙ্গ করে খেলতে নিল না, সেদিন বাড়ি এসে খুব কেঁদেছিলাম। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন “শারীরিক অক্ষমতা জীবনের মানদণ্ড হতে পারে না। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। তোমার মাথা অনেকের চেয়ে উঁচু হবে।” বাবার ওই কথাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র। এই আদর্শকে পাথেয় করেই আমি অনেকের অবজ্ঞা, কৌতুক ও অকারণ সহানুভূতিকে দূরে সরিয়ে স্কুলের শিক্ষিকা হতে পেরেছি। ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই শরীর নিয়ে আজও ঠাট্টা, বিদ্রুপ শুনতে হয়। তবে ছোটবেলার মতো আর কান্না পায় না। বরং অন্যের বিদ্রুপ আমার মনের জোর বাড়িয়ে দেয়। আমি বিশ্বাস করি যাঁরা শিক্ষিত নন, অলস, সেবাপরায়ণ নয়তাঁরাই সামাজিক ভাবে প্রতিবন্ধী। |
|
তুহিনকণা নাজির। —নিজস্ব চিত্র। |
গ্রামে আমাদের যৌথ পরিবার। ছোটবেলা থেকেই পাঁচ জনের অবজ্ঞার জবাব পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে, গান গেয়ে, ছবি এঁকে দিয়েছি। এগরার স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরে মেদিনীপুরের গোপ কলেজে উচ্চশিক্ষা। হস্টেলে থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করে বিএড-ও করেছি। তারপর সাত বছর একটি নার্সারি স্কুলে পড়ালাম। ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এগরার কেঁউটগেড়িয়া বিদ্যাসাগর হাইস্কুলে শিক্ষকতায় সুযোগ পাওয়ার পর লড়াইয়ের পথ কিছুটা মসৃন হয়েছে।
তবে, আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হলেও বামন বলে আজও পথে-ঘাটে লোকজনের বাঁকা দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। বাড়ি থেকে বারো কিলোমিটার দূরে স্কুল। ট্রেকার আর মোটর ভ্যানে চেপে স্কুলে যাই যখন রাস্তায় অনেকে হাসাহাসি করে। স্কুলেও অনেক হেনস্থা সইতে হয়েছে প্রথম দিকে। সহকর্মীরা মানবিক ছিলেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে বেঞ্চের উপর উঠে যখন ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতাম, গ্রামবাসীরা অনেকেই জানালা দিয়ে উঁকে মেরে দেখতেন। চোখে জল আসতে দিইনি কখনও। মন দিয়ে পড়াতাম। ধীরে ধীরে ছাত্রছাত্রীদের মন জয় করেছি। স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের অনেককে ফিরিয়ে এনেছি। সারদা মিশনের মাধ্যমে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য করি নিয়মিত। বৃদ্ধ বাবা-মা-র সেবা করি। বাড়িতে দাদা, দিদি, বৌদিও আমার জন্য গর্বিত।
এখন সকলেই আমাকে সম্মান করেন, অন্তত আমার লড়াইকে তো সম্মান করেই। ৪২ বছরের সংগ্রামময় এই জীবনে একটা কথাই জেনেছি ‘নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজেকে সম্মান করতে হবে।’ কর্ম দিয়ে শারীরিক ত্রুটিকে জয় করে বাবার কথা সত্যি করেছি। আজ আমার মাথা অন্য অনেকের থেকে উঁচুগর্ব করে এটুকু বলতেই পারি।
|
(অনুলিখন: অমিত কর মহাপাত্র) |
|
|
|
|
|