|
|
|
|
‘আমি মেয়ে বটি, কিন্তু কাম করি মরদের মতন’ |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
বাবু আমার কানের দুলজোড়া দেখিছ? সোনার মতো দেইখ্তে কিন্তু সোনা লয়। যেমন, আমি মেয়ে বটি। কিন্তু কাম করি মরদের মতন।”
মাথা থেকে কাঠের বোঝা নামিয়ে চারিদিকে সতর্ক চোখে মেপে নিয়ে পরক্ষণেই লক্ষ্মীর প্রশ্ন, “তোমরা ফরেস্টার লও তো?” না শুনে আশ্বস্ত হয়ে বলেন, “কী করব বাবু, পেটের জন্য ছেলেকে ঘরে রেখে জঙ্গলে যাই। কুড়ুলের কোপে গাছের ডাল কাটি। তার পর কাঠের বোঝা লিয়ে সোজ্জা চলি যাই ঝাড়গ্রাম শহর। এক বার ফরেস্টার ধরিছিল। সোজা বলি দিছিলাম, ঘরে ছোট ছ্যানা (ছেলে) আছে। আমাকে দেখার কেউ লাই। দু’বেলা ভাত দিবি, তবে গাছ ভাঙব না। এ কথা শুনি আমাকে ছাড়ি দিছিল। আর ধরে লাই।”
ঝাড়গ্রাম ব্লকের বাঁধগোড়া পঞ্চায়েতের জঙ্গল ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম টিয়াকাটি। গ্রামের লোধা পাড়ার এক প্রান্তে অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া ইট-কাদার গাঁথনির বেআব্রু এক চৌখুপি ঘরে বছর সাতেকের ছেলেকে নিয়ে থাকেন লক্ষ্মী কোটাল। আদিম উপজাতিভুক্ত লোধা সম্প্রদায়ের লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছিল জামবনির খাটখুরার সোনা কোটালের সঙ্গে। বছর ছ’য়েক আগে সোনার মারা গিয়েছে। শ্বশুরঘরে লক্ষ্মীকে নেয়নি। বাপের বাড়ির কাছে দাবিদারহীন এই বাড়িটাই লক্ষ্মীর আস্তানা। আলাদা বাড়িতে থাকেন লক্ষ্মীর বাবা, সত্ মা ও ভাইবোনেরা। বাপের বাড়ির কেউই অবশ্য লক্ষ্মীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। কেন? লক্ষ্মীর জবাব, “আমার মতো উয়ারাও লিজেদের খাবার জুটাতে হিমসিম খাছে, তো আমাকে কী দেইখবে? কারও তো জমি-জিরেত লাই।” ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এক কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বছর তিরিশের লক্ষ্মী। |
|
কাঠ বিক্রি করেই সংসার চালান লক্ষ্মী। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম ভাঙে লক্ষ্মীর। শাল ডাল দিয়ে দাঁতন সেরে জঙ্গলে প্রাতঃকৃত্য সারতে যেতে হয়। ঠোঁটে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে লক্ষ্মী বলেন, “জানো, জঙ্গলে জলের বড়ই আকাল। পড়শির পাতকুয়ো থেকে জল লিয়ে জঙ্গলে ফাঁকে যাই।” চা খেতে বড় ভালবাসেন লক্ষ্মী। জানালেন, “যে দিন ঘরে চিনি থাকে না, সে দিন চিনির বদলে নুন দিয়েই চা খাই।” বিস্বাদ লাগে না? উদাস গলায় লক্ষ্মী জবাব দেন, “আমার জীবনে কোনও সোয়াদ লাই গো! রং-ও লাই। তবু রঙিন শাড়ি পরি। ছ’টাকা দামের সোনা-রঙের ঝুঠা দুল পরি। কী করব, আমাকে সাদা কাপড়ে দেইখ্লে ছেলেটা কাঁদে যে। আমি রনি থাইক্যলে ছানাটার মন ভালা থাকে।” লক্ষ্মী কোনও দিন স্কুলে যাননি। তবে ছেলেকে স্থানীয় শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পাঠান। সেখানে ছেলেটা অন্তত মিড-ডে মিল খেতে পায়। কোনওদিন খায় ডিম-ভাত। কোনও দিন ভাতের সঙ্গে সায়াবিনের তরকারি। বলতে গিয়ে তৃপ্তিতে ভরে ওঠে লক্ষ্মীর মুখখানি।
গ্রামের অদূরে ডুংরিবনির জঙ্গলে সকাল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করেন লক্ষ্মী। তারপর মাথায় কাঠের বোঝা চাপিয়ে সাত-আট কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যান ঝাড়গ্রাম শহরে। শহরের কয়েকটি হোটেল এখনও জ্বালানি কাঠ কেনে। বরাত জোরে কোনও দিন অবশ্য আশি-একশো টাকা দাম পাওয়া যায়। কাঠ বেচার টাকায় চাল, আলু, তেল, নুন কিনে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফেরেন লক্ষ্মী। তারপর দূরের পুকুরের ঘোলা জলে স্নান সেরে এসে সন্ধ্যায় ঘরের এক কোণে মাটির পাতা উনুনে রান্না চড়ান। ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ। কোনও দিন শুধুই ভাত। রান্না করতে করতে লক্ষ্মী বলেন, “জঙ্গলে গেলে ভাত নয়তো উপোস। শরীর খারাপ হলে রোজগার বন্ধ। তখন চেয়েচিন্তে ছ্যানাটার জন্য মাড়ভাত জোগাড় করি।”
লক্ষ্মীর সম্পত্তি একটা খাটিয়া, ঘরের ভিতর টাঙানো দড়িতে কিছু ময়লা জামা-কাপড়। আর একটা পুঁটলি। তার মধ্যে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড-এর সঙ্গে কয়েকটা দশ টাকার নোট আর খুচরো পয়সা। লক্ষ্মীর অন্ত্যোদয় কার্ড আছে। প্রতি শনিবার রেশন আনতে যেতে হয় কিলেমিটার পাঁচেক দূরে নলবনা গ্রামে। অক্ষর পরিচয়হীন লক্ষ্মী সপ্তাহে পান দু’কেজি চাল আর হাফ লিটার কেরোসিন। জানেন না সপ্তাহে তাঁর জন্য সরকারি বরাদ্দ তিন কেজি চাল (মাসে ১২ কেজি)। ছেলের রেশন কার্ড নেই। হাড়ভাঙা খাটুনির জন্য পেটে আগুন জ্বলে। রেশনের দু’ কেজি চালে পোষায় না।
সদ্য জব কার্ড হয়েছে। এখনও একশো দিনের প্রকল্পে কাজ পাননি লক্ষ্মী। বিপিএল তালিকায় নাম নেই এই হতদরিদ্র মেয়ের। তাই ঘরে ইলেকট্রিক বাতি আসেনি। তাই বলে একদিন কি তাঁর সংসার ভরে উঠবে না আলোয়? লক্ষ্মী তাই সাধ করে ছেলের নাম রেখেছেন ‘সূর্য’। |
|
|
|
|
|