অনেকে বোধহয় ভাবতে পারেননি যে টেস্টের চতুর্থ দিনে অস্ট্রেলিয়া এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। চতুর্থ দিনের পিচে ব্যাটিং করা এমনিই প্রচণ্ড কঠিন। তবে তার সামনে পড়ে অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের যা দশা দেখলাম, তাতে নিশ্চয়ই ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখ কপালে উঠবে।
ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই লড়াকু জাতের। ভারতেও ওরা এসেছে বেশ কয়েক বার। রেকর্ড বিশেষ ভাল নয় ঠিকই কিন্তু ভারতকে প্রত্যেক বার ওরা প্রচণ্ড কঠিন যুদ্ধে ফেলেছে। প্রবল খাটাখাটনি করে ম্যাচ জিততে হয়েছে ভারতকে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা যে ড্রেসিংরুমে এত ভেঙে পড়েছে বলে ভাবা হচ্ছে, এটা তার একটা কারণ হতে পারে। বিশেষ করে মাইকেল ক্লার্ক। ও এমন একটা প্রজন্মের সঙ্গে ক্রিকেটটা খেলেছে যাদের কিনা জেতা বরাবরের অভ্যাস ছিল।
যদিও শেষ দু’টো টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার এই অবস্থা দেখে আমি অন্তত অবাক হইনি। গত কয়েক বছর ধরে ওদের যে টিমটা খেলছে, সেটা মোটামুটি অর্ধেক শক্তির। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে তো ঘরের মাঠেও ওদের হারের লজ্জা সহ্য করতে হয়েছে। বেশি পিছোতে হবে না, কয়েক দিন আগেই।
নিজেদের ঘরের মাঠে দীর্ঘ দিন ধরে অস্ট্রেলিয়াকে কেউ হারাতে পারেনি। আর ঘরের মাঠে একবার হারতে শুরু করলে তার একটাই মানে দাঁড়ায়। টিমটা বিপদে। পতনের সামনে। সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়ে গেল যে, শুধু পরিকাঠামো আর সিস্টেম দিয়ে ভাল ক্রিকেটার তৈরি করা যায় না। পরিবেশ যতটা দরকার হয়, ঠিক ততটাই প্রয়োজন হয় কোচিংয়ের। খুব বেশি পরিকাঠামো বা সিস্টেমের দিকে মন দিলে ক্রিকেটারদের স্বাভাবিক দক্ষতাটা নষ্ট হয়ে যায়। এই অস্ট্রেলিয়া টিমটার সমস্যা প্রচুর। টিমে ভাল স্পিনার যদি না থাকে, তা হলে ভারতে জেতা এক কথায় অসম্ভব। আর অস্ট্রেলিয়াকে যথাযথ সম্মান দিয়েই বলছি, এই মুহূর্তে ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে কমজোরি স্পিন আক্রমণ ওদের। আমাকে সবচেয়ে অবাক করে কী জানেন? যে দেশ ওয়ার্ন, ম্যাকগিল এমনকী ব্র্যাড হগকে নিয়েও এত গর্ব করে, তারা কি না একটা বিশ্বমানের স্পিনার তুলতে পারছে না!
অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংকেও দেখে মনে হয়নি কোনও দায়বদ্ধতা আছে বলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে এসে ওদের ব্যাটসম্যানরা ডিফেন্স করতে গিয়ে যে রকম ঝামেলায় পড়ছে, দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। খারাপ শট মারছে, মেরে আউট হচ্ছে। কারণটা জানেন? ডিফেন্সের সময় ওরা ক্লোজ ইন ফিল্ডারদের দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছে বলে। অনেকেই আগেভাগে কিছু শট ভেবে আসছে, যা শেষ পর্যন্ত ওদের বিপদে ফেলে দিচ্ছে। আমি তো বলব, মানসিক দিক থেকেও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের হারিয়ে দিয়েছে ভারতীয় স্পিনাররা। আমি বুঝে পেলাম না, দূরদর্শিতার জন্য যে দেশ এত বিখ্যাত, তারা কী ভাবে ভারত সফরের আগে মাইক হাসিকে অবসর নিতে দেয়! চূড়ান্ত অনভিজ্ঞ এই ব্যাটিং লাইন আপে হাসিকে দরকার ছিল।
ভারতের কথায় আসি। তিন জন স্পিনারই দুর্ধর্ষ খেলছে। মানসিক ভাবেও পিষে ফেলছে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের। যখনই অধিনায়ক বল দিয়েছে, তিন স্পিনারই নিজেদের কাজটা করে দেখিয়েছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গত সিরিজে ভারত প্রবল সমস্যায় পড়ছিল স্কোরবোর্ডে যথেষ্ট রান তুলতে পারছিল না বলে। কিন্তু একবার পাঁচশো উঠে গেলে অনায়াসে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাচ্ছে চারপাশে ফিল্ডার রেখে। মনে আছে, অনিল কুম্বলে ড্রেসিংরুমে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বলত, তোমরা আমাকে স্কোরবোর্ডে সাড়ে চারশো রান দাও, আমি তোমাদের টেস্ট জিতিয়ে দেব। কারণ ওই রান হাতে থাকলে স্পিনারদের আক্রমণ করতে সুবিধা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার দল নির্বাচন নিয়েও বেশ আশ্চর্য হলাম। এত দিন দেখেছি, অস্ট্রেলিয়া টেস্টের জন্য স্পেশ্যালিস্ট ক্রিকেটার খোঁজে। কিন্তু ওরা যে ভাবে ম্যাক্সওয়েল, ডোহার্টি এমনকী শেন ওয়াটসনকে বাছল, তাতে অবাক লাগছে। তার মানে অস্ট্রেলীয়রা এত দিন যে ভাবে ভাবত, সেগুলো এ বার পাল্টাচ্ছে। তিরিশের আশেপাশে ব্যাটিং গড় নিয়ে শেন ওয়াটসন টিমে ডাক পাচ্ছে মানে বুঝতে হবে, অস্ট্রেলীয় নির্বাচকদের কঠিন সময় চলছে। যাদের হাতে আবার ভাল প্রতিভারও অভাব। |