ধনেখালি থানায় নাসিরুদ্দিন মোল্লার মৃত্যু তদন্তে সিআইডির উপর অসন্তোষ প্রকাশ করল কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার সিআইডি তদন্তের অগ্রগতি রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ সিআইডিকে আরও সাত দিন সময় দিয়ে জানিয়ে দেয়, তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে অন্য কোনও নিরপেক্ষ সংস্থার হাতে তদন্তের ভার দেবে হাইকোর্ট।
আবেদনকারী এই জনস্বার্থের মামলায় সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছে। কিছু দিন আগেই গুড়াপের তদন্তের ভার হাইকোর্ট সিবিআইকে দিয়েছে। নাসিরুদ্দিন মৃত্যু তদন্তের অভিমুখও সেই দিকেই কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল। তদন্তের নথিপত্রে কারচুপি করা হয়েছে, এমন সন্দেহও প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি।
ডিভিশন বেঞ্চ সিআইডি-র কাছে তিনটি বিষয়ের ব্যাখ্যা চায়। প্রধান বিচারপতি রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়ে দেন, হাইকোর্ট চায় ঠিকঠাক তদন্ত। কিন্তু এ দিনের অগ্রগতি রিপোর্টে তা পাওয়া যায়নি। পুলিশ নাসিরুদ্দিনকে যে ধারায় গ্রেফতার করেছে বলে তদন্তে জানানো হয়েছে, ডিভিশন বেঞ্চ তা সমর্থন করতে পারেনি। আগের শুনানির দিনই বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী বলেছিলেন, পুলিশ যে ধারা দেখিয়েছে, ওই ধারায় গ্রেফতার করতে হলে গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রয়োজন। এ দিন তদন্তকারী অফিসার জানান, নাসিরুদ্দিনকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। বিচারপতির প্রশ্ন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন “ও আমাদের পাড়ার নাসিরুদ্দিন।” তা হলে নাসিরুদ্দিনের নাম ঠিকানা পুলিশ জানে না, তা বলা যাবে না। তাই ৪২ ধারায় গ্রেফতার হতে পারে না। |
নাসিরুদ্দিনের স্ত্রী মানুজা বিবি। |
রাজ্যের পাবলিক প্রসিকিউটর মনোজিৎ সিংহ ও রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের বক্তব্যের মধ্যে ফারাকও চোখে পড়ে। কী ভাবে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু হল এই প্রশ্নের উত্তরে মনোজিৎ সিংহ বলেন, হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে। প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে কি না, সেটা আইনজীবী বলতে পারেন না, বলতে পারেন চিকিৎসক। এই কথাবার্তা চলার সময়েই বিমলবাবু এজলাসে আসেন। তিনিও বলেন, কী ভাবে মৃত্যু হয়েছে, এটা ঠিক করা আইনজীবীর কাজ নয়।
আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের এ দিন প্রায় কিছুই বলার প্রয়োজন হয়নি। অগ্রগতি রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী নিজেরাই সব প্রশ্ন খুটিঁয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিপি-র জবাব দেওয়ার প্রায় কিছুই ছিল না।
কী ভাবে মৃত্যু হল? তদন্তে বলা হল, ধৃত ব্যক্তি মদ্যপ ছিল। থানায় আনার পরে পড়ে যায়। আহত নাসিরুদ্দিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়। থানার লক আপে তাঁর মৃত্যু হয়নি। ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, থানা থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ে মৃত্যু হলেও তা হয়েছে পুলিশের হেফাজতে। হাসপাতালের বেডের টিকিটও দেখাতে পারেননি তদন্তকারীরা। সিআইডি এ দিন এজলাসে একটি ল্যাপটপ আর একটি সিডি নিয়ে আসে। বলা হয়, সেটি থানার সিসি টিভি ফুটেজ। কিন্তু দেখা যায়, সেখানে কয়েকটি স্থিরচিত্র রয়েছে। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, সিসি টিভি-র ফুটেজ থেকেও নিঃসন্দেহ হওয়ার অবকাশ নেই। সিসিটিভি একটা এলাকার ছবি তুলতে পারে। থানার অন্যত্র যেখানে সিসি টিভি কাজ করে না সেখানেও তাঁকে মারধর করা হয়ে থাকতে পারে। তাই সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
সিআইডি জানায়, নাসিরুদ্দিনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। অথচ ময়না তদন্তে দেখা যাচ্ছে, শরীরে দু’তিনটি স্থানে ক্ষত ছিল। এখানেও হাইকোর্ট সন্দেহ প্রকাশ করে। সিআইডি জানিয়েছে, এক সাব ইনসপেক্টর ও দুই কনস্টেবলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চের প্রশ্ন, সাসপেন্ড করা হয়নি কেন?
তদন্তে ঘটনার ধারাবাহিকতায় বিস্তর অসঙ্গতি রয়েছে। গ্রেফতারের এক ঘন্টার মধ্যে এক জন জোয়ান মানুষ কী ভাবে মারা গেলেন, তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব সিআইডি এ দিন দিতে পারেনি। এই সব প্রশ্নের সঠিক জবাব নিয়ে ১৪ মার্চ হাইকোর্টে সিআইডি-কে প্রমাণ করতে হবে এ রকম মর্মান্তিক একটি মৃত্যুর তদন্তে কোনও ফাঁক বা ফাঁকি নেই। সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। প্রধান বিচারপতির ঘোষণা, সাজানো নয়, প্রকৃত তদন্ত দেখতে চান তিনি। না হলে তদন্তের দায়িত্ব বদলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে হাইকোর্ট। |