|
|
|
|
কেকের রাজপাট ছেড়ে গেলেন কলকাতার ইহুদি ‘অভিভাবক’ |
ঋজু বসু |
ডেভিড এলিজা নাহুম। নিউমার্কেটে কেক-বিস্কুট-চিজের ম-ম সুরভিতে প্রকাণ্ড কাঠের চেয়ারে বসে থাকা হাসি-খুশি গোলগাল বৃদ্ধ। বৃহস্পতিবার দুপুরে নারকেলডাঙার ইহুদি কবরস্থানে ভাই আইজাক যাঁকে সমাধিস্থ করে এলেন। এখন হাতে-গোনা কলকাতার ইহুদি-সমাজ। তবু তাদের বাদ দিয়ে কলকাতার বর্ণময় নাগরিক-জীবনের গল্প অসম্পূর্ণ। সাবেক ‘সিটি অব প্যালেস’-এর সম্ভ্রম-জাগানো ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে যিশুর জন্মদিনে আজকের বাঙালির কেক-পার্বন— সবেতেই বিরাট অবদান ইহুদিদের। “কলকাতা হয়তো আমাদের মনে রাখবে, কিন্তু আমাদের তো বয়স কমবে না! তাই লিখে দিন, কলকাতার ইহুদিরা আর বেশি দিন নেই।”—৮৬ বছরের নাহুম সাহেবের শেষকৃত্যের কিছু ক্ষণ বাদে নিরুত্তাপ স্বরেই প্রবীণ ‘অ্যাডম্যান’ ইয়ান জাকারিয়া এ কথা বললেন। |
|
দোকানের সামনে ডেভিড নাহুম। |
সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে আঠেরো শতকের শেষ দিকে পেশায় জহুরি শালোম কোহেনের কলকাতায় আসা! সে-দিন যে কাহিনির শুরু হয়েছিল, এটা তার শেষ অঙ্ক— বলছেন এই কলকাতার ইহুদিরাই। নিউমার্কেটের ১০০ বছরের কেক-বিপণি নাহুমের কর্ণধার ডেভিড নাহুম ছিলেন দীর্ঘ দিন কলকাত্তাইয়া ইহুদিদের অবিসংবাদী নেতা। এ শহরের ইহুদিদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের নথিভুক্তির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ব্রেবোর্ন রোডের সিনাগগ আর নিউ মার্কেটের নাহুমই
শহরে এই ক্ষীয়মান সম্প্রদায়ের স্মারক।
শোকের অভিঘাতে নাহুমের ঝাঁপ এ দিন বন্ধ থেকেছে। আজ, শুক্রবার সে ফের চোখ মেলবে। বন্ধ শাটারের গায়ে কম্পিউটার প্রিন্টআউট লটকে এ-কথা জানিয়ে দেওয়া হলেও সামনে দাঁড়িয়ে বিচলিত কলকাতার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। অনতি অতীতেই ফারপো, গ্রেট ইস্টার্ন, স্কাইরুমের মতো আদরের প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু তো কম দেখেনি এ শহর! ডেভিডের সহোদর আইজ্যাক দৃঢ় স্বরে জানিয়ে দিলেন, কোনও চিন্তা নেই। নাহুম থাকবে নাহুমেই। আইজ্যাক অবশ্য ’৫৬ সাল থেকে কখনও ইংল্যান্ড, কখনও ইজরায়েলবাসী। তবু কলকাতায় আসেন ঘন-ঘনই। এ বারও ডিসেম্বর নাগাদ এসেছিলেন। বললেন, “দাদা কয়েক বছর ধরেই হাঁটুর সমস্যা, কিডনির অসুখে কাবু। কিন্তু ম্যানেজাররা দক্ষতার সঙ্গে নাহুমকে টানছেন।”
ম্যানেজার জগদীশ হালদার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনন্ত হালদাররা বিলক্ষণ জানেন, নাহুমের জার্সির মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ! জগদীশবাবু ৩৪ বছর ধরে ডেভিডের বিশ্বস্ত অনুচর। কলকাতার ইহুদি-সমাজ বিষয়ক খুঁটিনাটিও অ্যাদ্দিনে তাঁর মুখস্থ। ইহুদিদের পালা-পার্বণে সিনাগগে নানা দায়িত্বও জগদীশবাবু সামলান। গেল পুজোর ঠিক আগে ইহুদিদের নববর্ষের পর-পরই একটি অনুষ্ঠানে রীতিমাফিক নারকোল পাতার সুদৃশ্য ঘর সাজিয়েছিলেন। কিন্তু দেখবে কারা? বয়সের ভারে বুড়োবুড়িরা প্রায় কেউই সে-বার আসতে পারেননি।
তবু এই ভাঙা-হাটেই ইদানীং বেশ লাগে সদ্য ভ্রাতৃহারা আইজ্যাকের। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে পিছুটান কমে গিয়েছে। ছেলে কাজ-কর্মে ব্যস্ত। হার্টফোর্ড লেনের বাড়ি তথা জন্মস্থানেই ফিরে আসতে চান তিনি। “আগে বাড়িটা গমগম করত। বাইরের রাস্তাটা শান্ত। এখন ঠিক উল্টো। তবু কলকাতার চেনা পথঘাট দেখলে কত পুরনো কথা মনে পড়ে যায়।”
কলকাতা থেকে মুছে যাওয়ার ছায়া দেখলেও, এই টানটুকুই ইহুদিদের সম্বল। |
|
|
|
|
|