স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মেয়ের সামনে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। জ্ঞান ফিরতে শুনলেন, একমাত্র সেই সন্তানও আর নেই। হাসপাতালের সাততলা থেকে পড়ে সে মারা গিয়েছে!
বৃহস্পতিবার ভোরে কয়েক মিনিটের মধ্যে এ ভাবেই বদলে গেল পাতিপুকুরের দেবশ্রী চক্রবর্তীর জীবন। সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন তাঁর ক্যানসার-আক্রান্ত স্বামী অরূপ চক্রবর্তী (৫২),
|
শ্রীরূপা চক্রবর্তী |
অপমৃত্যু হল কলেজছাত্রী কন্যা শ্রীরূপার (২০)। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, শ্রীরূপা আত্মঘাতী হয়েছেন। তদন্তকারীরা আপাতত মনে করছেন, বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে এমনিতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলেন ওই তরুণী। তার উপরে সংজ্ঞাহীন মাকে দেখে তাঁর মনে হয়, মা-ও আর বেঁচে নেই। এই যুগপৎ মানসিক ধকল সহ্য করতে না-পেরে পরিজনদের চোখ এড়িয়ে তিনি হাসপাতালের সাততলা থেকে ঝাঁপ দেন।
পারিবারিক-সূত্রে জানা গিয়েছে, পাতিপুকুরের জিসি ঘোষ রোডের বাসিন্দা অরূপবাবু কয়েক বছর ইস্তক ক্যানসারে ভুগছিলেন। মাঝে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও ক’মাস আগে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেমোথেরাপির জন্য বুধবার তাঁকে সল্টলেকের হাসপাতালটিতে ভর্তি করানো হয়েছিল। রাখা হয়েছিল সাততলার আইসিইউয়ে। হাসপাতাল-সূত্রের খবর: বুধবার সন্ধের পরে অরূপবাবুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ডাক্তারেরা বাড়ির লোকজনকে বলেছিলেন রাতে হাসপাতালে থাকতে। এ দিন ভোর ৪টে ৩৫ মিনিটে অরূপবাবু মারা যান।
সে সময়ে তাঁর স্ত্রী, মেয়ে-সহ বেশ কিছু আত্মীয় হাসপাতালে উপস্থিত। পরিজনেরা জানাচ্ছেন, স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েই দেবশ্রীদেবী জ্ঞান হারান। “তা দেখে শ্রীরূপা কেঁদে ওঠে। বলতে থাকে, মা-ও চলে গেল! আমরা দেবশ্রীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মেয়ের দিকে নজর রাখতে পারিনি। খেয়াল করিনি, ও কোথায় গেল।’’ বলছেন এক আত্মীয়। |
এবং পুলিশের অনুমান, ওই সময়েই সাততলার আইসিইউয়ের বাইরে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট খুলে শ্রীরূপা বাইরে লাফিয়ে পড়েন। হাসপাতালের পিছনে প্রায় ৬০ ফুট নীচে টিনের শেডের একাংশ ভেঙে গ্যাস পাইপলাইনের পাশে আছড়ে পড়ে তাঁর দেহ। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তখন বেসমেন্টে দু’জন কর্মী ছিলেন। আচমকা আওয়াজ পেয়ে তাঁরা ছুটে গিয়ে দেখেন, এক তরুণী পড়ে রয়েছেন। খোঁজ করতে করতে জানা যায়, সাততলায় আছেন ওঁর বাড়ির লোক। তাঁদের ডেকে আনা হয়। পরিজনদের তখন দিশেহারা অবস্থা। কিছুক্ষণ পরে চিকিৎসকেরা শ্রীরূপাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়না-তদন্তের জন্য দেহ আরজিকরে পাঠানো হয়।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ তদন্তে নামে। বিধাননগর দক্ষিণ থানার অফিসারেরা হাসপাতালে কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। হাসপাতালের এক রক্ষীর বক্তব্য, ঘটনার সময়ে তাঁদের শিফ্ট বদল হচ্ছিল। তাই পিছন দিকে কেউ ছিলেন না। কিন্তু ফায়ার এক্সিটের সামনে তো নজরদারি থাকার কথা!
সূত্রের খবর: শিফ্ট বদলের সুবাদে তখন কর্মীর সংখ্যা তুলনায় কম ছিল।
উপরন্তু সাততলার যে ক’জন নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মী মজুত ছিলেন, তাঁরাও মূলত দেবশ্রীদেবীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। ওইটুকু সময়ের মধ্যে শ্রীরূপা কোথায় গেলেন, তা কেউ খেয়াল করেননি।
এ দিন ভোরে পাতিপুকুরের পাড়ায় বাবা-মেয়ের মৃত্যুর খবর পৌঁছাতেই তিনতলা বাড়ির সামনে পড়শিদের ভিড় জমে যায়। বাসিন্দারা জানান, অরূপবাবু ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। শ্রীরূপা ওরফে কুটুন পড়তেন ইস্ট ক্যালকাটা গার্লস কলেজে, প্রথম বর্ষে। প্রতিবেশী নিশীথ মণ্ডল বলেন, “বাবা, মেয়ে দু’জনেই পাড়ার যে কোনও উৎসব-পার্বনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। দুর্গাপুজো-কালীপুজো নিয়ে উৎসাহের অন্ত ছিল না। পুজোয় নিত্যনতুন প্রতিযোগিতার আয়োজন করত কুটুন। ওর বাবাও যোগ দিতেন।” শ্রীরূপার বন্ধু শমীককুমার ঘোষের আক্ষেপ, “গত পুজোতেও কত আনন্দ করলাম! কুটুন শাঁখ বাজাল। ভাবতে পারছি না, ও নেই!” শ্রীরূপার মেসোমশাই কুমারেশ ঘোষের কথায়, “মেয়ে ছিল বাবা অন্তপ্রাণ। কোনও দিন বাবার অবাধ্য হয়নি।”
অরূপবাবুর দাদা অরুণাভ চক্রবর্তী পেশায় ডাক্তার। তাঁরা পরিবারশুদ্ধ হাসপাতালে। বাড়িতে ছিলেন তাঁদের মা দীপালিদেবী। প্রতিবেশীরা জানান, বৃদ্ধাকে সকালে ছেলে-নাতনির মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি। বেলা বারোটা নাগাদ দেবশ্রীদেবীকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন আত্মীয়েরা। শাশুড়িকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বামী-কন্যাহারা প্রৌঢ়া। দুপুর আড়াইটে নাগাদ এল অরূপবাবুর দেহ। দু’ঘণ্টা বাদে শ্রীরূপার দেহ। বাড়ির সামনে তখন তিলধারণের ঠাঁই নেই।
বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ দু’টো দেহ নিমতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল। বাড়িতে রয়ে গেলেন সন্তানহারা দুই মা দীপালিদেবী ও দেবশ্রীদেবী। সামনে দাঁড় করানো থাকল কুটুনের সাদা রঙের প্রিয় স্কুটি। |