|
|
|
|
অশ্রু মুছে সাহসিনী |
উনিশ বছরের তনুশ্রী। বাবা সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পর কন্যা পুলিশের
চাকরিতেই।
আত্মবিশ্বাসে দৃপ্ত। নারী দিবসে তাঁর কথা লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
চোখে মাইনাস টু-পয়েন্ট-ফাইভ পাওয়ারের মেয়েটা জীবনের স্টিয়ারিং ধরে ফেলেছে। এবড়োখেবড়ো অচেনা রাস্তায় ‘ড্রাইভিং’ শিখতে সময় লেগেছে সাকুল্যে ১৫-২০ দিন। মেয়ে যার ব্যাখ্যা দেয়, “ক্র্যাশ কোর্স। পরিস্থিতি ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়েছে।”
এই তো সে দিন, মানে ২০১৩-র ১২ ফেব্রুয়ারি বাবার জন্মদিন ছিল। বাবা কথা দিয়েছিলেন, গার্ডেনরিচ হরিমোহন কলেজে নির্বাচনের ডিউটি শেষ করে সন্ধে-সন্ধে বাড়ি ফিরবেন। ভালমন্দ খাওয়া হবে। কিন্তু তাঁর মৃতদেহ ফিরেছিল বাড়িতে। বাবার জন্মদিন আর মৃত্যুদিন একাকার হয়ে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল মেয়ের চারপাশ। তাপস চৌধুরীর গুলিবিদ্ধ দেহ আর তার অনুষঙ্গ হিসাবে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়া একের পর এক ঘটনা ছোটবেলা থেকে চাপা, অন্তর্মুখী তনুশ্রীকে টেনে-হিঁচড়ে কয়েক ঘণ্টায় আরও পরিণত করে ফেলেছিল। নিঃশব্দে অভিভাবক বদলে গিয়েছিল বেহালার সারদাপল্লির আড়াইতলা বাড়িটার। সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তনুশ্রী চৌধুরী।
এটুকু বলে আলতো হাসলেন তনুশ্রী, হাসতে হাসতেই ঠোঁট দু’টো শক্ত করে চাপলেন। চোয়ালে টান পড়ল একটু। ভাসা-ভাসা চোখ দু’টোয় শূন্য দৃষ্টি। চশমাটা খুলে নিলেন। কয়েক সেকেন্ডে চোখের কোল গড়িয়ে নামল জলের ফোঁটা। দ্রুত হাতের চেটোর উল্টো দিক দিয়ে মুছলেন। “জানেন, এত দিন টেলিভিশনের খবরে বা সিনেমায় দেখতাম অমুক পুলিশ অফিসারকে খুন করেছে, তমুক পুলিশ অফিসারকে বোমা মেরেছে, কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। সব দেখে খারাপ লাগত। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা আশঙ্কাও হত। কিন্তু আজ বুঝি সেটা কতটা সাময়িক বা বাহ্যিক ছিল। বাইরে থেকে দেখা আর বাস্তবে, নিজের সঙ্গে ঘটার মধ্যে কী ভীষণ তফাত! দেখা কত সোজা, সওয়া কত কঠিন! কী ভাবে ওই মুহূর্তগুলো আপনি পার করবেন তার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা থাকে না। কতটা মাথা ঠান্ডা করে, কতটা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে আপনি সময়টার সঙ্গে ডিল করতে পারছেন সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।” এত কিছু শিখলেন কী করে তনুশ্রী? ১৯ বছর ২ মাস বয়সে এত কিছু শেখা যায়? তা-ও পরিপাটি পারিবারিক নিরাপত্তা আর যত্নের মধ্যবিত্ত আবহে মানুষ হয়ে? |
|
তনুশ্রী চৌধুরী। |
“আসলে ওই ভাবে কিছু শেখা যায় না। পুরোটাই সময়ের ব্যাপার। পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষকে সব শিখিয়ে নেয়। আমার দিদা অঞ্জলি চক্রবর্তী আট ছেলেমেয়ে নিয়ে মাত্র ৩০ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। ছোট মামার বয়স তখন দুই। রেলের চাকরি করে একা হাতে দিদা সেই যুগে সবাইকে মানুষ করেছিলেন। আর আমি এইটুকু লড়াই পারব না?” বিজ্ঞানের ছাত্রী আবার এই লড়াইয়ে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গুঁজে দেন, “ইভোলিউশন পড়েননি? যেমন যেমন কঠিনতা, বাধা সামনে আসবে জীব তার সঙ্গে যোঝার জন্য নিজেকে বদলে ফেলবে। বাবাকে ছাড়া আমাদের বাঁচতে হবে, এটাই বাস্তব। একে মানতে হবে। কেন এ রকম হল, সেটা ভাবা বেকার। পরিস্থিতির সঙ্গে মানাতে হবে। আমি শুধু এটুকু মাথায় রাখছি যে, মা আর ভাই এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যা করার আমাকেই করতে হবে।”
মানুষ আর তার অস্তিত্বের প্রেক্ষাপট বোধহয় এ ভাবেই বদলায়। সরস্বতী পুজোয় পছন্দের শাড়ি পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলেন বেহালা বিবেকানন্দ কলেজের বটানির ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী তনুশ্রী। কার্যক্ষেত্রে কী হল? সেই সরস্বতী পুজোর তিন দিন আগে থেকেই তনুশ্রী লাখো সংবাদমাধ্যম, পুলিশের ছোট-বড়-মেজ কর্তা, রাজনীতিক-মন্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সামলালেন। মা মিনতিকে আগলে রাখলেন, ভাই তমাল (যার আদরের নাম পিকলু) টিভি ক্যামেরার সামনে বাবার খুনিকে এনকাউন্টারে উড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানানোয় চূড়ান্ত ক্ষিপ্রতায় মাইক সরিয়ে ভাইকে চোখের ইশারায় চুপ করালেন এবং তার তিন দিনের মাথায় বাবার ছবিতে প্রণাম করে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ-এর টপ সিক্রেট বিভাগে চাকরিতে যোগ দিলেন।
“চাকরির প্রস্তাবটা আসার পর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি আমার। ততক্ষণে প্রায়োরিটি ঠিক করে নিয়েছি। মা আর ভাইকে দেখতে হবে আমায়। চাকরিটা থাকলে সুবিধা হবে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের জন্য অর্থনৈতিক জোর দরকার,” কেটে কেটে বলেন তনুশ্রী।
|
তাপস চৌধুরী |
শুনতে শুনতে মা মিনতি অন্যমনস্ক হয়ে আঁচলের খুঁট বুড়ো আঙুলে ঘষছিলেন। কিছু দিন আগেও যে মেয়েটাকে নেহাত ছোট্ট মনে হত, যাকে কোচিং থেকে দেরি করে ফেরার জন্য বকা দিয়েছেন, হাতে ভাতের গ্রাস পাকিয়ে কলেজ যাওয়ার সময় মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, সেই মেয়েটা এক ধাক্কায় কী করে যেন বড্ড বড় হয়ে গেল। কান্না পেলে সেই ছোট্ট মেয়েটার কাঁধ এখন সম্বল, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিতে সে-ই ভরসা। কোনও দিন চাননি মেয়ে পুলিশের চাকরি করুক। পুলিশের চাকরি মানেই মারদাঙ্গা, পরিবারকে সময় দিতে না পারা। “কোনও অনুষ্ঠানে স্বামীকে পেতাম না। একটু বসে গল্প করা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, কিচ্ছু করা যেত না। ছাই চাকরি। কোনও দিন চাইনি ছেলেমেয়ে এই চাকরি করুক। অথচ, মেয়ে সেই পুলিশেই ঢুকল।”
তনুশ্রীর কিন্তু পুলিশের চাকরিতে আপত্তি ছিল না। বরং ভাল লাগত তার। শার্লক হোমসের ভক্ত মেয়ে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন, স্নাতক হয়ে পুলিশের চাকরির প্রস্তুতি শুরু করবেন। একান্ত না-হলে শিক্ষিকা হওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। বাবাকে বলেওছিলেন সেই কথা। খুব একটা গুরুত্ব দেননি তাপসবাবু। “বাবাকে অফিস নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে খুব বিরক্ত হত। বলত, ‘অফিসের কথা শুনে কী করবি?’ বাবাকে যখনই বলতাম আমি পুলিশের চাকরিতে যোগ দিতে চাই, বলত, ‘আগে রোগা হ, দৌড়তে শেখ, তারপর ভাববি।’”
ঘটনাচক্রে দৌড়তে শেখার আগেই স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে চাকরিটা হয়ে গিয়েছে তনুশ্রীর। পিছনে ছেড়ে এসেছেন কলেজের নিয়মিত ক্লাস, বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখা, আড্ডা মারা, গান শেখার ইতিবৃত্ত। সামনে অনেক কাজ বাকি পড়ে রয়েছে তাঁর। ভাল নম্বর পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে চাকরির ফাঁকেই। রয়েছে তার থেকেও বড় কাজ। বাবার দৌলতে ফাঁকতালে সরকারি চাকরি পেয়ে গিয়েছেন এমন অভিযোগ দশ বছর বাদে কারও মুখে যাতে না শোনেন তার জন্য নিজেকে কাজের জগতে কিছু করে দেখাতে হবে। “আজ বাবার মৃত্যুর জন্য সবাই আমাকে ছাড় দিচ্ছেন। অল্প কাজ দিচ্ছেন। কিন্তু এই ভাবে তো দিন যেতে পারে না। কাউকে বলার সুযোগ কেন দেব? কেনই বা অন্যায় সুযোগ নেব? নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে আমাকে।”
১৯ বছরের হঠাৎ পরিণত কাঁধে অনেক গুরুদায়িত্ব। ১২ ফেব্রুয়ারির আগের আর জীবনের স্টিয়ারিংটা ছেড়ে দেওয়ার আর প্রশ্নই নেই। |
ছবি: দীক্ষা ভুঁইয়া |
|
|
|
|
|