গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং রাজ্য সরকার যেন তাল মিলিয়েই পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছে।
মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কার্যত নালিশ জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দ্বারস্থ হলেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। এই দিনই মহাকরণ সূত্রে খবর, মোর্চার বন্ধে কাজে যোগ না দিলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাটা হবে। যে ক’দিন কর্মীরা অফিসে আসবেন না, তাঁদের চাকরির মেয়াদও কমবে তত দিন। সরকারি সূত্রে খবর, দার্জিলিংয়ে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তও নিয়েছে মহাকরণ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ পাহাড় সফরের পর থেকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়। গুরুঙ্গ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর দল ও রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করতে শুরু করে দেন। মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূল মুখে কিছু না বললেও রাজ্য সরকারের একের পর এক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বোঝা গিয়েছিল, মোর্চা সম্পর্কে কড়া মনোভাবই নিতে চলেছেন তাঁরা। প্রথমে জিটিএ-র প্রধান সচিবের পদ থেকে দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনকে সরানোর দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। তার পরে মোর্চার আপত্তিতে কান না দিয়ে গড়া হয় লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ। সেই পরিস্থিতিতেই মোর্চা ১৪-১৫ মার্চ এবং ২২-২৩ মার্চ বন্ধ ডেকেছে। ৯ মার্চ থেকে টানা ১৯ দিনের জন্য সরকারি কর্মচারীদের অফিসে যেতেও বারণ করেছে মোর্চা নেতৃত্ব। সে ক্ষেত্রেও পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে কঠোর মনোভাব নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ কর্তা মঙ্গলবার মহাকরণে বলেন, “পাহাড় তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নয়। তাই বন্ধ, হরতাল করে আইন ভাঙলে রাজ্যের অন্যত্র যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, দার্জিলিঙেও তাই হবে। কোনও একটা দল যা চাইবে, তাই-ই হবে, এমন জমানা এখন শেষ।”
তবে মোর্চা যে রাজ্যের এই সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নেবে না, তার ইঙ্গিত এই দিন মিলেছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় তামাংয়ের কথায়। বিনয় বলেন, “রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র কিন্তু কিছু বলেনি। বাকি অফিস তো জিটিএ-র অধীনে। এখানে রাজ্য সরকার কেন নাক গলাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।” স্বরাষ্ট্র দফতরের ব্যাখ্যা, পাহাড়ের জেলা প্রশাসন এবং জিটিএ কর্মীদের বেতন দেয় সরকার। ফলে বেতন কাটার ক্ষমতাও তাদেরই হাতে।
এ দিন মহাকরণে যান দার্জিলিঙের ডিআইজি দময়ন্তী সেন। স্বরাষ্ট্র সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর বিস্তারিত কথা হয়েছে। সরকার যে নতুন করে পাহাড়ে অশান্তি হতে দেবে না, তা পুলিশ কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছে মহাকরণ। এই উদ্যোগে কেন্দ্রও রাজ্যের পাশে রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সফরের সময় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে পাহাড়ের পরিস্থিতি জানিয়ে রেখেছিলেন। ফলে রাজ্য আধা-সেনা চাইতেই তড়িঘড়ি তা পাঠিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্র। দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত দুই কোম্পানি সিআরপি পাহাড়ে নামানো হচ্ছে। বিভিন্ন ‘স্ট্র্যাটেজিক’ এলাকায় এই বাহিনী থাকবে। প্রয়োজনে ‘কার্যকর’ ভূমিকা নিতেও কাজে লাগানো হবে। বন্ধ, হাঙ্গামা, জমায়েতের মাধ্যমে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা হলে সিআরপি দিয়েই তা দমন করা হবে বলে সরকারি স্তরে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ দিনই মোর্চা নেতারা নয়াদিল্লিতে শিন্দের সঙ্গে দেখা করেছেন। শিন্দের কাছে গুরুঙ্গের অভিযোগ, রাজ্য সরকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তি মানছে না। জিটিএ-র কাজকর্মে ‘বড্ড বেশি হস্তক্ষেপ’ করা হচ্ছে। গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের কাছেও মোর্চার নালিশ, কেন্দ্র পাহাড়ে গ্রামোন্নয়ন খাতে যে অর্থ দিচ্ছে, তাতে রাজ্য নাক গলাচ্ছে। স্বশাসনের চুক্তি অনুযায়ী জিটিএ-র হাতেই সরাসরি উন্নয়নের টাকা আসার কথা। মোর্চার অনুরোধে পাহাড়ে গ্রামোন্নয়নের কাজ খতিয়ে দেখতে ৭-৮ এপ্রিল দার্জিলিং যাচ্ছেন রমেশ।
মোর্চার সঙ্গে কংগ্রেসের সখ্য আগামী দিনে নতুন কোনও রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে পারে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল দিল্লিতে পৌঁছেই গুরুঙ্গ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তার পর দীপাই মোর্চা নেতাদের রেলমন্ত্রী পবন বনসলের কাছে নিয়ে যান। মঙ্গলবার শিন্দের সঙ্গে গুরুঙ্গের বৈঠকের সময়ও মোর্চা নেতাদের সঙ্গে ছিলেন দীপা। অতীতে গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে সফল করতে গুরুঙ্গরা বিজেপি-র যশোবন্ত সিংহকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার পরে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে মোর্চার সখ্য গড়ে উঠেছিল। আগামী দিনে কি তবে মোর্চার সমর্থন কংগ্রেসের দিকে যাবে? গুরুঙ্গের জবাব, “আগামী দিনে কী হবে, তা আগামী দিনেই বলা যাবে।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “আগুন নিয়ে খেলছে কংগ্রেস। কয়েক জন কংগ্রেস নেতা যদি ভেবে থাকেন, মুখ্যমন্ত্রীকে সাময়িক রাজনৈতিক চাপে রাখবেন, তা হলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। মনে রাখা উচিত, তাঁরা কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় রয়েছেন। জিটিএ চুক্তি তিন পক্ষের মধ্যে হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার একটি পক্ষ। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পরই তা গঠিত হয়। আমরা যে কোনও ভাবে পাহাড়ে শান্তি ও উন্নয়ন বজায় রাখব।” |