ঘরের কাজ মানেই মেয়েদের কাজ? এবং সে কাজের কোনও স্বীকৃতি দরকার নেই?
কেন এটা মেনে নেওয়া হবে? প্রশ্ন উঠছে। সুলক্ষণ। |
উত্তরপ্রদেশের মহারাজগঞ্জের দু’সন্তানের মা সাফিয়া খাতুন (২০১২) বা ইলাহাবাদের রেণু অগ্রবাল (২০১০), এঁরা দু’জনেই গৃহবধূ। দু’জনই পথদুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। বিমা বাবদ অর্থ নিয়ে পরিজনদের মামলা-মোকদ্দমা করতে হয়েছে, কারণ বিমা কোম্পানি মনে করে, এই মহিলাদের ঘরের কাজের আদৌ কোনও দাম ছিল না। তাঁদের ঘরের কাজের মূল্য কত? বা টাকার মাপে কত ধরা হবে?
ঘরের কাজকে মূল্য দেওয়া নিয়ে তাত্ত্বিক স্তরে কিছু কিছু আলোচনা আগেও হয়েছে। ইদানীং বৃহত্তর পরিসরেও এ বিষয়ে কথা উঠতে শুরু করেছে। কিছু কাল আগে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার পর কেন্দ্রীয় সরকার এ নিয়ে নানা রাজ্য সরকারের মতও চেয়েছে। এ রাজ্যে আলোচকরা মজুরির পক্ষে নন, কিন্তু গৃহশ্রমের স্বীকৃতির পক্ষে। আবার, গোয়া সরকার গত জুলাই থেকে তিন লাখ টাকার কম পারিবারিক আয়, এ রকম পরিবারের গৃহবধূদের নিজস্ব আয় না থাকলে মাসিক ১০০০ টাকা করে ভাতা দেবে বলেছে। সওয়া এক লাখ পরিবার এই সুবিধা পাবে।
ঘরে কোনও মেয়ে থাকলে সেই মেয়েই যে ঘরের কাজগুলো করবে, সে মেয়ে বাইরে কাজ করুক বা না-ই করুক, এটা চিরকালই স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। তবু প্রশ্ন উঠছিলই, কেন এমনটা হবে? বিশেষত মেয়েরা যখন থেকে বাইরের কাজে বেরোতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই এ বিষয়ে একটা সচেতনতা এসেছে। শিল্পবিপ্লবের সময় মেয়েদের মজুরি কম, শ্রম সস্তা বলে মেয়েরাই বেশি কাজ পাচ্ছিলেন। সেটা পরিবার আর সমাজকে টালমাটাল করে দিচ্ছিল। ফলে পুরুষের জন্য ‘পারিবারিক মজুরি’ আদায় করে মেয়েদের ঘরে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
আমাদের মতো দেশে ঘরের কাজ শব্দটার অর্থ কিন্তু অনেক বিস্তৃত। বহু মেয়ে পরিবারের নানা কাজে বিনা মজুরিতে খাটেন, তাঁরা সেই কাজগুলো না করলে মজুরি দিয়ে করাতে হত। চাষিবাড়ির মেয়ে ধান সেদ্ধ করে শুকোতে পারেন, তাঁতিবাড়ির মেয়ে সুতো রং করতে পারেন, দোকানদারি থাকলে চায়ের দোকান চালান ঘরের মেয়েরা। |
কিংবা, গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে দিয়ে জ্বালানির অর্থ সাশ্রয় করা, গরু পুষে দুধ বা হাঁস-মুরগি পুষে ডিম বিক্রি সাশ্রয়ের ফলে পরিবারের যে অর্থটুকু বেঁচে গেল বা সরাসরি আয় হল সেটুকু কিন্তু তাঁদের নিজস্ব আয় বলে গণ্য নয়, তাঁরা নিজেরাও সে ভাবে ভাবেন না। তাই দেশের কাজের হিসেবে তাঁরা আসেন না। এ দেশের শ্রমশক্তির তথ্যের অন্যতম উত্স জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় এ ধরনের কাজে মেয়েদের ভূমিকাকে স্বনিযুক্ত বিনা মজুরির সহায়ক বলে চিহ্নিত করেছে, স্বনিযুক্ত কর্মী বলে চিহ্নিত হন পরিবারের পুরুষরা যিনি জমিটা বা দোকানটার মালিক। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের সহায়কের ৭৪ শতাংশ মেয়ে, শহরে অর্ধেক। মালিক পুরুষ, অর্থপ্রাপ্তি তাঁর, খাটবেন মেয়েরাই।
কী কী ধরনের সাশ্রয়কারী কাজে মেয়েরা আছেন? গ্রাম-শহরে তফাত থাকলেও, মোটের উপর চাষবাসে আছেন তাঁদের ৭৮ শতাংশ। বাকিরা আছেন পশুপালন, রেশম গুটি প্রজনন, সূচিশিল্প, জরির কাজ, দরজির কাজ, বাঁশ-বেতের কাজ, পাথর কেটে জিনিস বানানোর কাজে। পরিষেবায় তাঁরা তুলনায় কম। তবু খুচরো ব্যবসা, বিশেষত নিজেদের খাবার দোকান, এমনকী ঠেলা বা ভ্যানগাড়ি চালানোতেও আছেন। আছেন ছোট কারখানাতেও। বেসরকারিকরণের ফলে বেড়েছে সাব-কন্ট্র্যাক্ট। ফলে বেড়েছে ঘরে বসে কাজের মাত্রা, যা স্বনিযুক্ত কাজের অন্যতম উত্স। এই কাজের ধরন বাড়া মানে কাজের সুযোগ বাড়া, না কি সুযোগের অভাব বাড়ার লক্ষণ, সে নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। যা-ই হোক, সেখানে অন্যতম কর্মী কিন্তু ঘরের মেয়েরাই, সহায়ক হিসেবে।
কিন্তু তথ্য যাদের শ্রমশক্তিতে ধরছে না? জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় শ্রমশক্তিতে নেই বলে ধরা হয় ছাত্রছাত্রী, শুধুমাত্র বাড়ির কাজে রয়েছেন এমন মানুষ, বাড়ির কাজের সঙ্গে বাড়িতে ব্যবহারের জন্য ফল-পাকুড়-পাতা কুড়োনো, সেলাই ইত্যাদি কাজে যুক্ত, পেনশন পান বা শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষরা। এঁদের মধ্যেও ঘরের কাজে নিযুক্ত যে মেয়েরা, তার প্রায় ৫০ শতাংশ কিন্তু এমন কাজ করেন, যেগুলো আসলে সাশ্রয়কারী কাজ। অতএব সরাসরি না হলেও পরোক্ষে অর্থকরী তো বটেই। তবে নমুনা সমীক্ষার সাম্প্রতিকতম রাউন্ডে মেয়েদের তথ্য দেখিয়েছে যে কাজ কমছে, বেশি সংখ্যক মেয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন বলে তাঁরা শ্রমশক্তিতে আসছেন না, না-কি আসলে কাজের সুযোগ কমছে, তা নিয়েও আর এক দফা বিতর্ক শুরু হয়েছে, এ নিয়ে আলোচনা বারান্তরে।
ঘরের কাজ ‘কাজ’ কি না, নতুন করে সেই বিতর্ক ওঠে ষাটের দশক থেকেই। দেখা গেল, পশ্চিমি দেশেও বাইরের কাজ বাড়লেও ঘরের কাজের সিংহভাগ মেয়েরাই করেন। এ কাজের জন্য মজুরির দাবি হইচই ফেলে দেয় ১৯৭৫ সালে আইসল্যান্ডের মেয়েরা ধর্মঘট ডাকার ফলে। এর পর ১৯৯১ সালে সুইজারল্যান্ডে, ১৯৯৯ সালে মেক্সিকোতে ধর্মঘট। কিন্তু কে দেবে মজুরি? স্বামী না সরকার? না-কি মজুরি নয়, চাই সেগুলোর সামাজিক বিকল্প? শুধু অস্ত্র কেনায় নয়, সরকারি ভর্তুকিতে কেন নয় হেঁশেল আর ক্রেশ? অথবা ধোপাখানা? না-কি ঘরের কাজ শুধু মেয়েদের কাজ, এই ধারণাটা মুছে ফেলার মন্ত্র প্রচার? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৬-০৭ সালের প্রথম সারির ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা দেখিয়েছে, দু’জনেই বিজ্ঞানী, এ রকম দম্পতির ক্ষেত্রে রান্না, ঘর পরিষ্কার আর কাপড় কাচার কাজের ২৮ শতাংশ পুরুষরা আর ৫৪ শতাংশ মেয়েরা করেন।
ঘরের কাজ মেয়েদেরই কাজ এই মন্ত্রে মেয়েরা নিজেরাও বিশ্বাস করেন। তাই, কার কেরিয়ার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রশ্নে দু’জনে এক জন পুরুষ বলেন তাঁর নিজের, ২০ শতাংশ মেয়ে সেটা বলেন। আর সমান সমান গুরুত্ব দেন ৬০ শতাংশ মেয়ে আর ৪৫ শতাংশ পুরুষ বিজ্ঞানী। তবু নানা ভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ, জাতীয় আয়ের হিসেবে তা কী ভাবে ঢোকানো হবে, তা নিয়ে কাজ করছে। অনেক দেশে পরীক্ষাও হচ্ছে। কিন্তু তাতে ঘরের কাজের বিনিময়ে মেয়েরা কী পাচ্ছেন? যাঁরা পারেন, তাঁরা কি অন্য মেয়েদের সেই কাজের জন্য মজুরি দিয়ে নিয়োগ করে তাঁদের আবার শোষণ করছেন? কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, কোয়েবেক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এ রকম বেশ কয়েকটি দেশ, ঘরের কাজ যে-ই করুক না কেন, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ছুটি, করছাড়, কাজের ঘণ্টার হেরফের, কাজের জায়গা বা দফতর বদলের ব্যবস্থা করেছে। সেই সঙ্গে ঘরের কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের জন্য সরাসরি ভাতা আর পেনশনের ব্যবস্থা করেছে। এদের মধ্যে সব ক’টি দেশ সব ব্যবস্থা হয়তো করেনি, কিন্তু সুযোগগুলো নানা ভাবে প্রসারিত হচ্ছে। ঘরের কাজ নিয়ে আমরাও নতুন করে ভাবব কি? |