রাজকোষ ঘাটতির হার কমানোর উদগ্র তাড়নায় অর্থমন্ত্রী ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যের কথা ভাবলেন না।
বৃদ্ধির হার বাড়ানোর দায় তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়েছেন।
কিন্তু ব্যাঙ্ক এখনই সেই দায় নিতে রাজি নয়। ফল, অচলাবস্থা। |
সামগ্রিক অর্থনীতি (ম্যাক্রো-ইকনমি) পরিচালনার দুটো পৃথক নীতি ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত একটি ফিসকাল পলিসি বা রাজস্ব নীতি; অপরটি মানিটরি পলিসি বা আর্থিক নীতি। জন মেনার্ড কেইনস এবং তাঁর পরবর্তী অর্থনীতিবিদরা রাজস্ব নীতির অর্থাত্ এক দিকে করের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা, আর অন্য দিকে সেই টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ করা ওপর জোর দিয়েছিলেন। এই নীতিতে অর্থনীতি পরিচালনা করতে হলে স্বভাবতই রাষ্ট্রের হাতে অধিকতর ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কেইনসীয় ঘরানার মতে, স্বাধীন ভাবে খরচ করতে পারার এই অধিকার রাষ্ট্রের হাতে থাকাটা বাঞ্ছনীয়। রাজস্ব নীতিই, তাঁদের মতে, অর্থনীতি পরিচালনার শ্রেয় এবং প্রগতিশীল পন্থা।
এই অবস্থানের বিপরীত মেরুতে আছেন রক্ষণশীলরা। তাঁরা আর্থিক নীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করার পক্ষপাতী। বাজারে টাকার জোগান ও ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে-কমিয়ে, এবং সুদের হার কম-বেশি করে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের ঋণ নিতে উত্সাহ দিয়ে বা নিরুত্সাহ করে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার এবং মূল্যস্ফীতির হারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই আর্থিক নীতির মূল কথা। এই আর্থিক ব্যবস্থায় বাজার এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীই মুখ্য সরকারের ভূমিকা মূলত বাজার প্রক্রিয়াকে বাধাহীন ভাবে চলতে দেওয়ার মতো অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং বাজারের ওপর নজরদারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
দুই ঘরানার মধ্যে সংঘাত স্বাভাবিক। ১৯৮০-র দশক থেকেই রক্ষণশীল, বাজারপন্থীরা সেই লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছেন। গোটা দুনিয়াতেই অর্থনীতি পরিচালনার পথ হিসেবে আর্থিক নীতির ব্যবহার বেড়েছে। এই পন্থার একটা মূল উদ্দেশ্য হল সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত একটি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গঠন করা, যার হাতে দেশের আর্থিক নীতি নির্ধারণের ভার থাকবে। সরকার যদি বাজার থেকে প্রচুর ঋণ নিয়ে রাজস্ব নীতি পরিচালনা করতে চায়, তার প্রভাব এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতির ওপর পড়বে না। ভারত ‘আর্থিক সংস্কার’-এর পথে হাঁটতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গেই এই মডেলে ঢুকে পড়েছে।
২০১৩-১৪ সালের বাজেট এই প্রবণতাকেই চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গিয়েছে। এই বাজেটে যদি একটিও লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য থাকে, তা হল, অর্থমন্ত্রী তাঁর হিসেবের খাতায় রাজকোষ ঘাটতির হার কমিয়ে দেখাতে ভয়ানক ব্যগ্র ছিলেন। তিনি ২০১২-১৩ অর্থবর্ষের শেষ ক’মাসে সরকারি খরচ প্রাণপণ কমিয়েছেন, যাতে রাজকোষ ঘাটতির হার তাঁর লক্ষ্যসীমার মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের (জি ডি পি) ৫.২ শতাংশের মধ্যে থাকে। |
বাজারেই সমাধান? অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম। |
নিঃসন্দেহে সে কাজে তিনি সফল। ২০১৩-১৪’র বাজেটে তিনি ঘোষণা করেছেন, রাজকোষ ঘাটতির হারকে জি ডি পি-র ৪.৮ শতাংশে বাঁধবেন। কী ভাবে? এক দিকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির অনুমানে তিনি প্রবল আশাবাদী, অন্য দিকে বিবিধ খরচে ভয়ানক কাঁচি চালিয়েছেন। মুশকিল হল, রাজকোষ ঘাটতির সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে গিয়ে তিনি অনেক কিছু ত্যাগ করতে রাজি হয়ে গেলেন।
রাজকোষ ঘাটতির হার কমানোর খেলায় প্রথম শহিদের নাম সরকারি ব্যয়। অর্থমন্ত্রী অনুমান করেছেন, ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে টাকার অঙ্কে ভারতের জি ডি পি ১৩.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। এ দিকে, গত বাজেটের সঙ্গে এই বাজেটের তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, খরচ বাড়ছে ১১.৭ শতাংশ হারে। অর্থাত্, সরকারি ব্যয় এবং অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের অনুপাত এই বছর কমছে। তার মানে, রাজকোষ থেকে খরচ করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টাতেও ভাটা পড়বে। অর্থমন্ত্রীর এই অবস্থানের কল্যাণে ইউ পি এ সরকারের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রকল্পগুলোরও খুব বেশি বাড়তি বরাদ্দ জোটেনি। মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের কথাই ধরুন। ইউ পি এ সরকার গরিব মানুষের জন্য যে ক’টি বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে, এটা তার অন্যতম। আংশিক হলেও এত দিন খানিক মনোযোগ প্রকল্পটি পেয়েছিল। এ বছর এই প্রকল্পে ভাল টাকা বরাদ্দ করা হবে বলেই অনুমান ছিল আম-আদমির উন্নতিকল্পে না হোক, ভোটের কথা মাথায় রেখে। দেখা গেল, অর্থমন্ত্রী এই প্রকল্পে বরাদ্দ করেছেন ৩৩,০০০ কোটি টাকা। গত বাজেটে প্রণব মুখোপাধ্যায় ঠিক এই পরিমাণ টাকাই এই প্রকল্পকে দিয়েছিলেন; খরচ হয়েছিল সামান্য কম ২৯,৩৮৭ কোটি টাকা।
দ্বিতীয়ত, চিদম্বরম ঘাটতি কমানোর উপায় হিসেবে মূলত ভর্তুকির ওপর কোপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা বিল নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল, তখন কংগ্রেস যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রতিফলন এই বাজেটে নেই। আগামী অর্থবর্ষে খাদ্য ভর্তুকির পরিমাণ স্থির করা হয়েছে ৯০,০০০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে এই খাতে খরচ হয়েছে ৮৫,০০০ কোটি টাকা। অনুমান করা চলে, বরাদ্দ যেটুকু বাড়ল, তা ফসলের বর্ধিত দাম মেটাতেই খরচ হয়ে যাবে। বাড়তি দাম দিতেই যদি বাড়তি বরাদ্দ খরচ হয়ে যায় তবে আরও বেশি লোককে খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। যাঁরা এখন খাদ্য ভর্তুকি পান, তাঁদের হাতে বেশি খাদ্য তুলে দেওয়াও সম্ভব হবে না। অর্থাত্, খাদ্য নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যে কাজগুলো করার কথা, অর্থমন্ত্রী সেগুলোকে গোড়ায় মেরে রাখলেন।
সারে ভর্তুকির পরিমাণও কার্যত অপরিবর্তিত থাকল। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে সরকার এই খাতে মোট ৬৫,৯৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল। এই বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৬৫,৯৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাত্ চাষবাস যখন ক্রমে আরও অলাভজনক হয়ে যাচ্ছে, তখন অর্থমন্ত্রী কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন না। এর পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, পেট্রোলিয়ম খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৯৬,৮৮০ কোটি টাকা থেকে কমে হবে ৬৫,০০০ কোটি টাকা। সব মেলালে, ২০১২-১৩ সালে ভর্তুকি দিতে সরকার আসলে মোট যে টাকা খরচ করেছে, ২০১৩-১৪ সালে তার চেয়ে খরচ ১০ শতাংশেরও বেশি কমবে।
অর্থমন্ত্রী কী ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেটা এত ক্ষণে স্পষ্ট। প্রণববাবু অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব ছাড়ার পর চিদম্বরম যখন ফের অর্থমন্ত্রী হলেন, তখন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অতি জটিল ছিল এক দিকে বেলাগাম মূল্যস্ফীতি, অন্য দিকে ধাক্কা খাওয়া আর্থিক বৃদ্ধির হার। এই অবস্থায় সরকারি ব্যয়ের মুঠি খুব কষে বাঁধলে আর্থিক বৃদ্ধির হার আরও কমবে। এবং, আমার অনুমান, এই বাজেটের ফলে মূল্যস্ফীতির হার ফের চড়বে। খেয়াল রাখা ভাল, দেশের প্রায় সব পণ্যের বাজারেই পেট্রোলিয়মের প্রভাব পড়ে। ডিজেলের দাম বাড়লে সব পণ্যেরই দাম বাড়তে বাধ্য। তার ফলে সার্বিক মূল্যস্তরও চড়বে। অর্থাত্, এই বাজেট এক দিকে সরকারি খরচের হাত বেঁধে অর্থনীতিকে উত্সাহ দেওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিল, অন্য দিকে মূল্যস্ফীতির দরজা খুলে দিল। যুগপত্ আর্থিক বৃদ্ধিতে ভাটা এবং চড়া মূল্যস্ফীতির হার ভারতে চলছেই। এই বাজেটের ফলে তা তীব্রতর হবে। যাঁদের ওপর সেই দ্বৈত-সঙ্কটের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে, এই বাজেটে তাঁদের জন্য কার্যত কিছুই নেই। এই বাজেট কংগ্রেসের রাজনৈতিক ক্ষতি করতে বাধ্য, কারণ লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই শেষ বাজেট।
বাজেট দেখে মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী নিশ্চিত যে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলায় রাজস্ব নীতি ব্যবহারের আর কোনও উপায় নেই, কারণ রাজকোষ ঘাটতির হার কমানোর দিকে তাঁকে নজর দিতেই হবে। অর্থমন্ত্রী যে এ দিকেই জোর দিচ্ছেন, সেটা এ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও বেশ বোঝা যাচ্ছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দুনিয়া জুড়ে যে আর্থিক মন্দা চলছিল, ভারতীয় অর্থনীতি তা থেকে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে মূলত সরকারি ব্যয়ের দৌলতেই। কিন্তু অর্থনীতির ফের যে গতিভঙ্গ হয়েছে, তার জন্য দায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর আর্থিক নীতি। বর্ধিত সরকারি ব্যয়ের ফলে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বাজেট পড়ে মনে হল, অর্থমন্ত্রী বুঝি বলতে চাইছেন, যেহেতু ব্যাঙ্কের নীতির ফলেই আজ এই অবস্থা, এখন ব্যাঙ্কই ভারতীয় অর্থনীতিকে ফের চড়া বৃদ্ধির হারের কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক। স্পষ্টতই, ব্যাঙ্ককে এই কাজটা করতে হলে শিথিল আর্থিক নীতির মাধ্যমেই করতে হবে।
তবে, অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে এই কথাটা বুঝিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পর পর বেশ কয়েক দফা রেপো রেট যে সুদের হারের মাধ্যমে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে সুদের হার স্থির করার ইঙ্গিত দেয় বাড়িয়েছিল। রেপো রেট বেড়েছিল প্রায় তিন শতাংশ। সম্প্রতি ব্যাঙ্ক সুদ বাড়ানো বন্ধ করে। সামান্য কমায়ও। তবে সামান্যই, ০.২৫ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চোখে ভারতের প্রধান সমস্যা দুটো: এক, মূল্যস্ফীতির চড়া হার; দুই, ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে, বাজারে টাকার জোগান বাড়লে, ঋণ সস্তা হলে এই সমস্যা দুটোই আরও বাড়বে। যেহেতু ব্যাঙ্ক এখনও এই দুটো সমস্যাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, তাই এখনই সুদের হার কমিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করার পথে হাঁটতে ব্যাঙ্কের যথেষ্ট আপত্তি আছে।
সরকার আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অবস্থানের দৌলতে ভারতীয় অর্থনীতি এক অচলাবস্থার মধ্যে পড়ল। বাজার-বান্ধব, বাণিজ্যমুখী আর্থিক ব্যবস্থা ভারতে সত্যিই বিপাকে পড়েছে। |
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |