পরীক্ষায় গণ-টোকাটুকির হিড়িক কি আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়া আসিতেছে? চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার ‘অভিশাপ’ হইতে মুক্ত হইয়া রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা কি ১৯৭২-৭৭-এর গণ-টোকাটুকির সুবর্ণ মহিমায় প্রত্যাবর্তন করিতেছে? ভাবগতিক দেখিয়া তেমনই সন্দেহ হয়। গত বৎসর এবং চলতি বৎসরেও মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালে যে ভাবে রাজ্যের নানা প্রান্তে গণ-টোকাটুকি চলিয়াছে, তাহা চমকপ্রদ। পরীক্ষাকেন্দ্রের বাহিরে গাছের ডালে বসিয়া, কখনও সারিবদ্ধভাবে কার্নিশের উপর দাঁড়াইয়া ভিতরে বসা কলম-কামড়ানো পরীক্ষার্থীদের ‘পুরিয়া’ সরবরাহ করা হইতেছে। কোথাও বা খেলার ধারাবিবরণী দিবার ভঙ্গিতে হাত-মাইক ফুঁকিয়া প্রশ্নপত্রের একের পর এক দুরূহ জিজ্ঞাসার উত্তর শুনাইয়া দেওয়া হইতেছে। পরীক্ষার্থীরা তাহা শুনিয়া শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে মাধ্যমিকের চৌকাঠ ডিঙাইতে চেষ্টা করিতেছে। যেন গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের নৈরাজ্যপীড়িত শিক্ষাচিত্রটিরই পুনরভিনয়!
একটা তফাত অবশ্য আছে। গত শতকের গণ-টাকাটুকিতে পুলিশের কোনও নীরব দর্শকের ভূমিকা ছিল না, সন্ত্রস্ত পুলিশ পারতপক্ষে পরীক্ষাকেন্দ্রের ছায়া মাড়াইতে চাহিত না। পরীক্ষার্থীরা রীতিমত বেঞ্চের উপর ছোরা গাঁথিয়া টুকিতে বাধা দিবার সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে পরীক্ষকদের আগাম সতর্ক করিয়া দিত। পরিবর্তিত জমানায় পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হইয়াছে। প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রেই পুলিশ হাজির। তবে ওই উর্দিধারীদের অস্তিত্ব কেহ স্বীকার করিতেছে না। পুলিশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া, তাহার চোখের সামনে বা নাকের ডগায় টোকাটুকির এই গণ-উৎসব চলিতেছে। টেলিভিশনের সংবাদ-চ্যানেল নিত্য সেই উৎসবের চলচ্ছবি দর্শকদের পরিবেশন করিতেছে। কিন্তু মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকরা গণ-টোকাটুকির এ ধরনের কোনও দৃশ্য দেখেন নাই, জানেনও না। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার সূত্র মানিলে তাঁহারা যখন দেখেন নাই, তখন ধরিয়া লওয়া যায়, ঘটনাটিও ঘটে নাই। তবে শিক্ষামন্ত্রী অত তীব্র ও প্রবল অস্বীকারের পথে যান নাই। তিনি বরং টোকাটুকিকে একটি সামাজিক ব্যাধি আখ্যা দিয়া তাহা নিরাময়ের সঙ্কল্প ঘোষণা করিয়াছেন।
সঙ্কল্পটি সাধু। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত টোকাটুকির ঘটনা সর্ব কালেই ঘটিয়া থাকে। টুকিয়া পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের একাংশ নিজেদের যাবতীয় অযোগ্যতা লইয়াই ভবিষ্যতে এমনকী শিক্ষকতার পেশাতেও যোগ দেন। ইহা অনভিপ্রেত। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্কল্প রক্ষিত হইবে কী রূপে? টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়াও বোর্ডের পরীক্ষায় বসিতে দিবার দাবিতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ঘেরাও করার অপকাণ্ডে যখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকরাও যোগ দেন, উচ্চতর ক্লাসে উঠিবার অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাতেও টুকিতে দিবার দাবিতে কিংবা না-দিবার প্রতিবাদে যখন অভিভাবকদের সঙ্গে লইয়া ছাত্ররা শিক্ষকদের মারধর করে, তখন ধরিয়া লওয়া যায় যে, এ রাজ্যে শিক্ষার বারোটা বাজিয়া গিয়াছে। পরীক্ষায় গণ-টোকাটুকি সেই অধঃপতনেরই আর একটি লক্ষণ মাত্র। |