পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বুঝি বিধাতারও কিঞ্চিৎ করুণা হইয়াছে। উল্টোডাঙার উড়ালপুলটি যে রবিবার ভোররাতের পরিবর্তে কোনও ব্যস্ত সময়ে ভাঙিয়া পড়ে নাই, তাহা দৈব অনুগ্রহ ভিন্ন অন্য কিছু ভাবিয়া লওয়া মুশকিল। কারণ, মানুষের পক্ষে বিশেষত ক্ষমতাসীন মানুষের পক্ষে যতগুলি ভুল করা সম্ভব ছিল, এই উড়ালপুলটির নির্মাণে সকলই হইয়াছে। তদন্তে বিভিন্ন কারিগরি ত্রুটির কথা প্রকাশ হইতেছে। কিন্তু সমস্যার মূল সেই ত্রুটিতে নহে। উড়ালপুলটিই দাঁড়াইয়া ছিল আপসের ভিতে। এই উড়ালপুল তৈরির টাকা দিয়াছিল কেন্দ্রীয় সরকার, জওহরলাল নেহরু জাতীয় নগর পুনর্নবীকরণ প্রকল্পে। বরাদ্দ হইয়াছিল মোট ৬৮ কোটি টাকা। কোনও প্রথম সারির বেসরকারি সংস্থাই সেই টাকায় পুলটি বানাইতে সম্মত হয় নাই। ন্যূনতম যে দর পাওয়া গিয়াছিল, তাহা ৯২ কোটি টাকা। ২৪ কোটি টাকার ফারাক সরকারি বরাদ্দের ৩৫ শতাংশ বেশি। অনুমান করা চলে, সত্যই ৬৮ কোটি টাকায় এই পুল যথাযথ ভাবে নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না, নচেৎ এই ২৪ কোটি টাকার ফাঁকে অন্তত একটি হইলেও দরপত্র জমা পড়িত। তাহা পড়ে নাই। কাণ্ডজ্ঞান বলে, এমন অবস্থায় পুলটি নির্মাণ না করাই বিধেয় ছিল। টাকা ফিরিয়া যাইত। কিন্তু তৎকালীন রাজ্য সরকার আপসের পথে হাঁটিল। প্রথম আপস একটি অপেক্ষাকৃত অদক্ষ সরকারি সংস্থার হাতে পুল নির্মাণের দায়িত্ব তুলিয়া দেওয়া হইল।
দ্বিতীয় আপস সংস্থাটি ৬৮ কোটি টাকাতেই পুল বানাইতে আরম্ভ করিল। তাহাদের নিজস্ব গবেষণা শাখা নাই, সরকারের বাছিয়া দেওয়া পরামর্শদাতাদের লইয়াই তাহাদের কাজ করিতে হয়। আরও অনেক খামতি লইয়া পুল নির্মাণের কাজ চলিল। তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, বেসরকারি সংস্থার দেওয়া ন্যূনতম দর, অর্থাৎ ৯২ কোটি টাকাই এই পুল নির্মাণের প্রকৃত খরচ। অতএব, ম্যাকিনটস বার্ন প্রকৃত খরচের মাত্র ৭৪ শতাংশে কাজ সারিতে বাধ্য হইল, তাহাও আপেক্ষিক অদক্ষতা এবং সরকারি হস্তক্ষেপসমেত। নির্মাণ কার্যে গাফিলতি থাকিবে, সস্তায় সারিয়া দেওয়ার প্রবণতা থাকিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী? তৃতীয় আপসটি আরও মারাত্মক। কেষ্টপুর খালে ফেরি যাতায়াত করিবে, এমন একটি অলীক আশা বামফ্রন্টের বহু দিন ছিল। উল্টোডাঙা উড়ালপুলের একটি পিলার খালের মাঝখানে পোঁতা আবশ্যিক ছিল, কিন্তু ফেরির জেটি নির্মাণে সমস্যা হইবে, এমন যুক্তি খাড়া করিয়া সেই পিলার তৈরি করিতে দেওয়া হয় নাই। কর্তাদের বোধ হয় ধারণা ছিল, কোনও ঐশ্বরিক শক্তি পুলটিকে ধরিয়া রাখিবে, কাজেই পিলারের তেমন প্রয়োজন নাই! ঈশ্বরবিশ্বাস কিঞ্চিৎ কম হইলে তাঁহারা বুঝিতেন, এই আপস করা চলে না। তাঁহাদের ঠিক করিতে হইত, খালে ফেরি আর খালের উপরে পুলের মধ্যে কোনটি বেশি জরুরি। যেটি তুলনায় কম জরুরি বিবেচিত হইত, তাহাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করাই বিধেয় ছিল। সরকারের সেই বিবেচনা ছিল না। সেই অভাবেই পুলের একটি অংশ কেষ্টপুর খালে নিমজ্জিত হইয়াছে। সেই খালে অবশ্য এখনও ফেরি চলাচল আরম্ভ হয় নাই।
আপসের অভ্যাসটি আমাদের, এবং রাজনীতিককুলের, মজ্জাগত। সেই অভ্যাসের জন্মস্থল একটি ধারণায় ‘ও কিচ্ছু হইবে না’। এত বিশ্বাস কোথা হইতে আসে, কে জানে! কোনও মতে সারিয়া ফেলিবার চরিত্রদোষটি ক্ষেত্রবিশেষে কতখানি মারাত্মক হইতে পারে, উল্টোডাঙার ভাঙা উড়ালপুল তাহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। আদর্শ পরিস্থিতিতে কোনও ক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র গাফিলতি সহ্য করিবার কথা নহে। তবে, আদর্শ পরিস্থিতি জিনিসটি বিরল, বিশেষত এই বঙ্গদেশে। অতএব, কর্তাদের বুঝিতে হইবে, কোন ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র আপস করা চলে না, আর কোথায় খানিক গাফিলতি করিয়াও পার পাওয়া যায়। উড়ালপুলের ন্যায় বাহ্যিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে আপসের কোনও স্থান নাই। যাহা দরকার, যতখানি দরকার, তাহার সমস্ত দেওয়া সম্ভব না হইলে এই জাতীয় প্রকল্পে হাত না দেওয়াই শ্রেয়। উড়ালপুল ভাঙিয়া পড়া অপেক্ষা উড়ালপুল না থাকা শহরের পক্ষে মঙ্গলের। আধুনিক হওয়ার আগে প্রাণে বাঁচিয়া থাকা জরুরি। বার বার ভাগ্যই বাঁচাইবে, এমন প্রত্যাশা বিপজ্জনক। |