মঙ্গলবার সকালে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে হেলমেট খুলতেই উৎসুক কয়েকটি মুখ তাকিয়ে রইল পালানের দিকে। বুঝলেন, উপস্থিত বেশ কয়েক জন তাঁকে চিনতে পেরে গিয়েছেন।
কেউ সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে দেখবেন, এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। তাই লজ্জায় আবার হেলমেট পরে নিয়েছেন পালান। সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে তাঁর মুখ। সোমবার থেকেই তো সাধারণ মানুষের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ‘সেলিব্রিটি’।
পালান ঘড়ুই, অমিত সরকার, অসিত দাস ও সজল চট্টোপাধ্যায় এই চার যুবক রবিবার ভোরে তারাপীঠ থেকে গাড়িতে কলকাতায় ফিরছিলেন। ভিআইপি রোড ছেড়ে বাইপাসের উড়ালপুলে ওঠার পরেই দেখেন সামনে আর রাস্তা নেই। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে না গিয়ে উড়ালপুল থেকে ভিআইপি রোডের দিকে নেমে এসে তারা ঘুরিয়ে দিতে থাকেন একের পর এক গাড়ির মুখ। তাঁদেরই উপস্থিত বুদ্ধি এবং মানবিকতার জন্য বেঁচে গিয়েছে অনেক মানুষের প্রাণ। সে খবর, সোমবার সকালে আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পরে কার্যত বদলে গিয়েছে চার যুবকের জীবন। |
সোমবার সকাল থেকেই আসতে শুরু করে একের পর এক ফোন। আত্মীয়-বন্ধুরা তো ছিলেনই, সঙ্গে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ। সকাল থেকে চার বন্ধু এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, দুপুর দেড়টার সময়ে বাড়িতে বাজার পৌঁছে দেন পালান। অমিত বাড়ি ফিরে ভাত খেতে বসেন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ। নিস্তার পাননি সন্ধেবেলাও। একটি টিভি চ্যানেল তাঁকে তুলে নিয়ে যান ‘লাইভ শো’-এর জন্য। সেখান থেকে বেরিয়ে ছুটতে হয় আর একটি চ্যানেলের অফিসে। অসিতের কথায়, “ভাল লাগছে। এত দিন তো শুধু অবজ্ঞাই দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, রবিবার ভোরে যখন গাড়িগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছিলাম, তখন এত কিছু মনে হয়নি।” সে দিন স্টিয়ারিং-এ বসেছিলেন এই অসিতই। উড়ালপুলে ওঠার সময়ে গাড়ির গতি যদি আর একটু বেশি থাকত, তা হলে দুর্ঘটনাগ্রস্ত লরিটার পরেই গাড়ি গিয়ে পড়ত খালে।
কপালের জোরে নিজেরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন বলে ঠিক হয়েছিল অসিত আর সজল মঙ্গলবার সকালে আবার সপরিবার তারাপীঠ যাবেন। কিন্তু সোমবার রাতেই ফোন আসে ফুলবাগান থানা থেকে। মঙ্গলবার সকালে থানার পিছনের ফাঁড়িতে কম্পিউটার-প্রশিক্ষিত যুবকদের মানপত্র দেওয়ার কথা আগে থেকেই ঠিক ছিল। সেখানে ডেকে নেওয়া হয় এই চার জনকে। বাতিল হয় তারাপীঠ যাত্রা। অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে পুলিশ কর্তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন তাঁদের নাম। বলেন, “আমাদের সামনে উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছেন এই যুবকের দল। ওঁরা সেখান থেকে চলে গেলে কেউ তাঁদের দোষ দিত না। কিন্তু অচেনা-অনাত্মীয় মানুষগুলোর প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা রয়ে যান সেখানে।” কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ প্রায় বুকের কাছে নিয়ে এসে চার জনের হাতে তুলে দেন স্মারক, ‘কমিশনার্স মেডেল’। পাশ থেকে উঠে আগ বাড়িয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে।
এতেই অভিভূত পালান। দত্তাবাদে ১৫ ফুট বাই ১১ ফুটের একটি ঘরে পার্টিশন দিয়ে মা-স্ত্রী-দুই মেয়ে আর ভাইকে নিয়ে সংসার। মাথা নিচু করে বলেন, “এত সুন্দর স্মারক বড় বেমানান ওই ঘরে।” |