পঞ্চাশ বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে সে-ও বছর পাঁচেক আগে। ঘরের মেয়ে ঘরে এল এতগুলো বছর পরে, সঙ্গে জামাই। “ওরে তোরা উলু দে,” “বরণডালাটা কই রে ছোটবৌ?”, “শাঁখ বাজা, প্রদীপ জ্বাল!”
নড়াইলের ভদ্রবিলা তো তখন কেঁদেকেটেই একসা! মায়ের সই, দিদির সহপাঠী, কোন ছেলেবেলার এক্কাদোক্কার সঙ্গীসাথীরা হতভম্ব। পায়ে ব্যথা, তবু সক্কলের আগে আগে শুভ্রাদেবী, সঙ্গে সব সময়ে তাঁকে আগলে রাখা দেবারতি মিত্র। এক এক জন এসে জড়িয়ে ধরছেন, আর রক্ষীরা শিউরে উঠছে। “বল দেখি আমি কে? ও-ও-মা চিনতে পারলি না! সেই যে...”
সত্যিই কাউকে চিনতে পারছেন না শুভ্রাদেবী! “ওওও! হ্যাঁ-হ্যাঁ। তা তোমার মেজদি কেমন আছেন?” চিনলেন শুধু কানাইবাবুকে, সম্পর্কে তাঁর ভাই। “কানাই না? ওই তো। হ্যাঁআআ!” সলাজ হেসে দিদিকে প্রণাম করেন কানাই। জামাইবাবুর দিকে এগোতেই হইহই করে ওঠেন প্রণববাবু, “না-না। ওদের কড়া বারণ!” যাদের বারণ, সেই রক্ষীরা তখন ঘিরে ফেলেছেন পড়শি দেশের রাষ্ট্রপতিকে। |
থমকে গেল ভদ্রবিলা। তা হলে প্রদীপ, মালা, বরণডালা? শুভ্রাদেবীই ভরসা। ছোটবেলার বান্ধবী কিরণ এগিয়ে এসে কানে কানে কিছু বলতেই রাঙা হয়ে উঠল তাঁর মুখ, “ধ্যাত!” তার পরে প্রণববাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওঁদের একটু রেহাই দাও না! এটা তো আমার বাড়ি, কেউ কিছু করবে না।” রক্ষীদের সরিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করলেন রাষ্ট্রপতি। সঙ্গে সঙ্গে সাত এয়ো ঘিরে ফেলল জামাইকে। গোড়ের মালা ছপাত করে পড়ল গলায়। উলু আর শাঁখে হইহই রইরই। ছোড়া হল খই। জামাই বরণ হল বুকে, কপালে, হাঁটুতে বরণডালা ছুঁইয়ে। তার পরে শ্বশুরবাড়ি ঢুকলেন প্রণববাবু, জীবনে প্রথম। নতুন জামাইকে সোনার চেন আর ধুতি-পাঞ্জাবি দিয়েছে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে দু’কেজি ঘি, গাছের কুল। শুভ্রাদেবী পেয়েছেন শাড়ি। কানাইবাবু খুব খুশি। কথা বলতে বলতে শিউরে উঠছেন। তাঁর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বললেন, “জামাইবাবুও আমাদের সক্কলকে ধুতি-পাঞ্জাবি বা শাড়ি দিয়েছেন। খুব ভাল মানুষ। এতটুকু গুমোর নাই!”
দুপুরের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি ছিল। প্রণববাবু বলেন, “আজ থাক। এখনও শিলাইদহ যেতে হবে, বেলা পড়ে আসছে...”। তখন ডাব এল। আর নড়াইলের বিখ্যাত কালাকাঁদ, সঙ্গে নারকোল নাড়ু, বাড়ির গাছের পাকা কলা।
প্রণববাবু বেশ কিছু ক্ষণ সেখানে কাটিয়ে কপ্টারে উঠে যান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার কুমুদিনী কমপ্লেক্স দেখতে। সেখানে ভারতেশ্বরী হোম দেশের অন্যতম সেরা স্কুল। কুমুদিনী হাসপাতালে রোজ হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা পান। রণদাবাবুর নাতি রাজীবপ্রসাদ প্রণববাবুকে আপ্যায়ন করে সব ঘুরিয়ে দেখান। লুচি, আলুর দম, পনিরের তরকারি, কাটারিভোগ চালের ভাত, নারকোল দিয়ে লাউ-ঘন্ট, ইলিশ ভাজি, সিম-বড়ি দিয়ে আড় মাছ, বাচা মাছের ঝাল, পোনার পেটি ভাজা, ভুনা মুরগি আর নানা ধরনের ফল ছিল মধ্যাহ্নভোজের পদ। মাছের ভক্ত হলেও প্রণববাবু এ দিন খুবই স্বল্প আহার করেন। বলেন, “বয়েস হয়েছে তো!” তবে কুমুদিনী ট্রাস্টের কাজকর্ম দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত।
এর পরে শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তাঁকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ঘুরে দেখেন প্রণববাবু। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির কপ্টার ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি যখন ছুঁল, ফিরতি বিমান ছাড়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় সওয়া ঘণ্টা আগে। কেমন হল আজকের ঘোরা? হা-হা করে হেসে উঠলেন রাষ্ট্রপতি, “নিজেকে মনে হচ্ছিল নতুন জামাই, দ্বিরাগমনে এসেছি। হাসিনা তো বলেছে, জামাইষষ্ঠীতে এ বার থেকে সে তত্ত্বও পাঠাবে!” |