পুস্তক পরিচয় ২...
অপহৃত স্বর্গোদ্যান, অপহৃত ঐতিহ্য

‘সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
’,
শামসুর রাহমানের কবিতার এই পংক্তি-সূত্রে বাংলা বর্ণমালা বা ভাষা ব্যবহারের আলোচনায় আমাদের টেনে আনেন অরুণ সেন। তাঁর ‘শামসুর রাহমানের একটি কবিতা’ নিবন্ধে উঠে আসে কবির স্বরান্তরের সঙ্গে কী ভাবে মিশে থাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের ওঠাপড়া— দেশভাগ, পূর্ববঙ্গে বাঙালির উত্তরাধিকার, পাকিস্তানি শাসনের পীড়ন-পেষণ, মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ প্রতিবাদ, নতুন দেশগড়ার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ। অরুণবাবুর নতুন বই সাহিত্যের বাংলাদেশ/ উপন্যাস কবিতা নাটক-এ (এবং মুশায়েরা, ২০০.০০) সে দেশের উপন্যাস-কবিতা-নাটক নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা।
কোনও সাম্প্রদায়িক বিচার থেকে নয়, কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যে সাম্প্রতিককে বুঝতে গেলে বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন, অর্থাৎ মুসলিম পরিচয় থেকে তার আত্মপরিচয়ে ফেরাকে বুঝতে হবে। সাহিত্য বা সংস্কৃতির আনাচকানাচে যেমন পূর্ববঙ্গের মুসলিম-মানস বরাবরই স্পষ্ট, তেমনই সেখানে নিয়ত উচ্চারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আর স্বপ্ন। অরুণবাবু তাই ’৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য-র আইনানুযায়ী সূচনা ধরলেও এর উৎস-ঐতিহ্যের খোঁজে পিছিয়ে গিয়েছেন বেশ কিছুকাল। লক্ষ করেছেন ‘দ্বিজাতি তত্ত্বকে ডিঙিয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়লাভ ও আত্মবিকাশ— যার বহিঃপ্রকাশ ভাষা ও সংস্কৃতিতে, সর্বাঙ্গীণ বাঙালিয়ানায় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে, এবং তারই সমান্তরালতায় বাঙালি মধ্যবিত্তের মনের বিস্তারে ও নিম্নবর্গের বাঙালির আত্মআবিষ্কারে।’ যাঁরাই বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস অনুপুঙ্ক্ষ জানতে চাইবেন, অরুণবাবুর বইটি পড়তেই হবে তাঁদের।
আর একটি বই, বাংলাদেশের নাটকনভেল/ কিছু আনাড়ি আন্দাজ (এবং মুশায়েরা, ২০০.০০), লিখেছেন দেবেশ রায়। তাঁর আলোচনা এগোয় সাহিত্যের বিশেষ-কে নিয়ে। সমাজ বড় না ব্যক্তি বড়, এরকম একটা কূট তর্কে জড়িয়ে পড়ি, অথচ ভুলে যাই যে সামাজিক মানুষের ইতিবৃত্ত জানাই যায় না, যদি-না ব্যক্তির ভিতরে সমাজটা আবিষ্কার করতে পারি। বাংলাদেশী জীবনে অস্তিত্ব বা চেতনার যে দৈনন্দিন পরিবর্তন, তা থেকে জন্ম-নেওয়া কথাসাহিত্য নিয়ে দেবেশবাবুর মন্তব্য ‘বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের নানারূপতা ও বিবিধ মাহাত্ম্য আমাকে মুগ্ধ করে।’ তার শিল্পরূপের আন্দাজ পেতে লিখছেন ‘বাংলাদেশের অসংখ্য নদীনালার মোহনার মত নানা রঙের, নানা উৎসের ও নানা কিসিমের জলে আবর্তিত হয়ে কুম্ভিপাক পাকিয়ে তোলে— ইয়োরোপীয় পরিভাষায় তাকে সুররিয়্যাল বলে বটে কিন্তু বাংলাদেশের গল্পের জটলা সুররিয়্যালের চাইতে অনেক বেশি জটিল।’
এই জটিলতার কারণ এক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার ভিতর নিহিত, মনে হয়েছে তাঁর। পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র হওয়ার দীর্ঘকালব্যাপী যে নিঃসঙ্গ নিভৃত সাধনা বাংলাদেশী শিল্পী-সাহিত্যিকদের, তাতে পশ্চিমবঙ্গও কী ভাবে এসে পড়ে তারও আন্দাজ দিয়েছেন দেবেশবাবু: ‘আত্মার সহোদর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা। এই মনোভাবটিকে ভুল করে একমাত্রিক ভাবা হয়। আমার মনে হয়েছে বিপরীত মাত্রিক। পশ্চিমবঙ্গের কাছে পূর্ববঙ্গ ছিল অপহৃত স্বর্গোদ্যান। পূর্ববঙ্গের কাছে পশ্চিমবঙ্গ ছিল অপহৃত ঐতিহ্য।’
বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যের আলোচনায় এ বই অরুণবাবুর বইটির পরিপূরক বললে বোধহয় অত্যুক্তি হয় না। তবে বইটির শুরুতে ‘বাংলাদেশের বাঙালি’ নিয়েও একটি নিবন্ধ আছে, তাতে আশির দশকের শেষাশেষি জন্মানো ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে দেবেশবাবু লিখছেন ‘বাংলাদেশের নতুন সাবালক নাগরিকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী আধুনিকতায় আর অচলায়তনিক মোল্লাব্যবস্থার মধ্যে কোনো বিনিময় সম্ভব নয়।’
এ কথাই তো সবচেয়ে সত্যি হয়ে উঠেছে আজ, প্রতিদিন বাংলাদেশে, তারুণ্যের প্রায়-সামুদ্রিক সমাবেশে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.