|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
ত্রুটি নেই উৎসবে |
নান্দীকার নাট্যমেলায়। দেখে এলেন মনসিজ মজুমদার |
প্রায় তিন দশক পরে চেতনার ক্লাসিক প্রযোজনা ‘জগন্নাথ’ আবার মঞ্চস্থ হল নান্দীকার নাট্যোৎসবে। কাস্টিং-এ কিছু পরিবর্তন হলেও প্রযোজনার বিন্যাসে ও পরিচালনায় নজরে পড়ার মতো কোনও বদল হয়নি। পরিচালনায় ও জগন্নাথ চরিত্রের ভূমিকায় অরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন এই চরিত্রে তাঁর বিকল্প নেই। তরুণ জগন্নাথের ভূমিকায় আজকের প্রবীণ অভিনেতা তরুণ সাজেননি, কিন্তু তাঁর অভিনয়ে লঘু গুরু তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম শ্লেষ ও কৌতুকের অভিঘাত সমেত জগন্নাথের ট্র্যাজিক ব্যক্তিত্ব আজও মঞ্চে অটুট ধরে রেখেছেন।
নান্দীকার নাট্যমেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল রঙ্গপটের ‘তথাগত’। সম্প্রতি প্রয়াত মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের এই জোরালো টেক্সট নিয়ে এক অনবদ্য প্রযোজনা পরিচালনা করেছেন তপনজ্যোতি দাস। অসংখ্য চরিত্রের ভিড়, নানা দৃশ্য ও ঘটনার আবর্তনে আলোড়িত এই নাটকের অচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু বুদ্ধ চরিত্রটি। কেবল সার্থক নাটকীয় অভিঘাত নয়, প্রযোজনার সাংগঠনিক বিন্যাসেও প্রয়োজন কেন্দ্রীয় চরিত্রের যথাযথ উপস্থাপনা। বুদ্ধের ভূমিকায় তপনজ্যোতির সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা-বৈচিত্রের অভিনয় সেই দুরূহ কাজ সফল করেছে। তাঁর বুদ্ধ ধীর স্থির, শান্ত ও সমাহিত, আত্মিক চেতনায় দীপ্ত অথচ রক্তমাংসের অনলৌকিক ব্যক্তিত্ব, উচ্চাবচতাহীন করুণাস্নিগ্ধ কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার অভাব নেই। জাগতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়েও নিরাসক্ত, সংঘের সংগঠনে ও সংরক্ষায় সতর্ক, সংকটে নিরুদ্বিগ্ন। মঞ্চ, আবহসঙ্গীত, চৌষট্টিজন কুশীলবের একক ও সম্মিলিত অভিনয় এই প্রযোজনার অপরিহার্য সম্পদ। |
|
হাবিব তনভিরের ‘চরণদাস চোর’ যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কাছে অসমের নাট্যদল বা দ্য ক্রিয়েটিভ ব্রিজের ওই একই নাটক করার প্রয়াস দুঃসাহসী বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরিচালক অনুপ হাজরা অসমিয়া ভাষায় (অনুবাদ: ভাগীরথী) এই রাজস্থানি লোককথা অসমের লোক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে আরোপিত করে যে প্রযোজনা মঞ্চস্থ করলেন তাতে সামগ্রিক ভাবে তাঁর শক্তি ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। অবশ্য তনভিরের ‘চরণদাস’-এর সঙ্গে সমান্তরাল পাল্লা দিলেও এই প্রযোজনায় অহমিয়া চোর (জিতু গোহেন) ছত্তিসগঢ়ি চোরের তুলনায় কিছুটা নিষ্প্রভ। পাকিজা বেগমের রানির সঙ্গে ফিদা বাইয়ের রানির তুলনার প্রয়োজন নেই, কারণ রানি ও চোরের আখ্যানে দু’টি চরিত্রই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে।
এ বার নাট্যমেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল দু’জন খ্যাতিমান পরিচালকের দু’টি প্রযোজনা। ওড়িশার সুবোধ পট্টনায়কের ‘চৃং চৃং’ আর অসমের বাহারুল ইসলামের ‘গ্রিন সারপেন্ট’। কিন্তু দু’টি প্রযোজনাই দর্শকের প্রত্যাশা সার্বিক পূর্ণ করতে পারেনি। ভুবনেশ্বরের নাট্য চেতনার ‘চৃং চৃং’ মূলত শিশুনাটক যার গল্প মানুষের জীবন নিয়ে কিন্তু পাত্রপাত্রীরা পশুপাখি এবং তার উদ্দেশ্য নীতিশিক্ষা। কথামালার গল্পের আদলে রচিত এই নাটকের লক্ষ্য সমাজজীবনে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদ। তাই এ নাটকের উদ্দিষ্ট দর্শক বড়রাই। কিন্তু প্রযোজনার নাটকীয় অভিঘাত মজার শিশুনাটকের স্তর থেকে সাবালক চেতনাকে নাড়া দেওয়ার স্তরে উঠতে পারেনি।
গুয়াহাটির সিগালের ‘গ্রিন সারপেন্ট’-এর বিষয় জনজাতি বিদ্বেষ এবং সংঘাত ও ব্যক্তিস্তরে তার মানসিক প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন জনজাতি, উপজাতি, সম্প্রদায় ও উদ্বাস্তুদের বাসভূমি অসমের যন্ত্রণাদীর্ণ দুঃসময়ের আবহ সমস্ত প্রযোজনায়। ভয়, আতঙ্ক, সন্ত্রাস, সংঘাত সব কিছুর উপস্থাপনা প্রতীকী এবং মূল প্রতীক একটি সবুজ সাপ যার থেকে নাটকের নাম। খ্রিস্টীয় সংস্কৃতিতে সাপ অশুভ প্রবৃত্তির প্রতীক। নাটকে সেই অশুভের সঙ্গে শুভের প্রতীকী ব্যঞ্জনা। জাতিদাঙ্গায় ধর্ষিতা নারীর ট্র্যাজেডিতে যেমন জোরালো নাটকীয় অভিঘাত ঘটে তেমনি যোগ্যতার অভাবে দুর্বল তার পরিণতি। ধর্ষিতা ধর্ষকের প্রতি প্রণয়-প্রবণ। এমন এক প্রতীকী ইঙ্গিত করুণ মনে হয় সারা দেশের এই ধর্ষণদীর্ণ সময়ের প্রেক্ষিতে। অথচ ভাগীরথী (মা) ও পল্লবী পুখনের (কন্যা) অভিনয় খুবই উল্লেখযোগ্য।
মুম্বইয়ের ট্র্যাম থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘আ বার্ডস আই ভিউ’ (পরিচালনা: চৈতী ঘোষ)। এই নাট্যকলায় একটি টেবিলকে মঞ্চ বানিয়ে পরিচালক পুতুল খেলা ও পুতুল নাচের চমৎকার সমন্বয়ে নানা আবহ শব্দ ও সঙ্গীত সংযোজন করে একটি পায়রার কাহিনি নিয়ে নাটক করেন। কাহিনিতে যুদ্ধবিরোধী বার্তা ছিল কিন্তু দর্শকদের যা মুগ্ধ করেছিল তা ওই নাট্যকলার অভিনবত্ব এবং পরিচালকের একক অনুষ্ঠান। |
|
|
|
|
|