আপনি কি ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে টিভির মধ্যে ঢুকে যান?
আপনি কি বন্ধুদের মিস করেন?
আপনি কি চেতন ভগতের ভক্ত? ‘থ্রি মিসটেকস অফ মাই লাইফ’ কি আপনার পড়া?
আপনার কি অভিষেক কপূরের ‘রক অন’ ছবিটা দারুণ লেগেছিল?
হয়তো এর মধ্যে কয়েকটার উত্তর, ‘হ্যাঁ’। কয়েকটার ‘না’।
হয়তো সব ক’টাই ‘হ্যাঁ’।
যা-ই হোক, ‘কাই পো চে’ দেখে আসুন।
আচ্ছা বেশ! তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, কারও কারও সব ক’টা উত্তরই ‘না’...
যা-ই হোক, ‘কাই পো চে’ দেখে আসুন। |
কী বলছেন? ব্রোম্যান্স বা বাডি ফিল্ম অনেকগুলো দেখে ফেলেছেন? ‘দিল চাহতা হ্যায়’ থেকে ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ অবধি? আপনার কোনটা প্রিয়? ‘থ্রি ইডিয়টস’? নাকি ‘রং দে বসন্তী’?
হিসেব পরে কষবেন! তার আগে ‘কাই পো চে’ দেখে আসুন! ‘দিল চাহতা হ্যায়’ বা ‘জিন্দেগি না মিলেগি...’-র জগৎ নয়। ‘থ্রি ইডিয়টস (এটা ছিল চেতনের ‘ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান’ অবলম্বনে)’ বা ‘রং দে...’-র ক্যাম্পাস লাইফ নয়। ‘রক অন’য়ের দুনিয়া থেকেও ‘কাই পো চে’ হাজার মাইল দূরে। অভিষেক কপূর দেখিয়ে দিলেন, তাঁর ক্যানভাসটা সত্যিই বড়। বন্ধুত্বকে বিষয় করে পর পর একদম আলাদা ছবি বানানোটা বেশ বড় চ্যালেঞ্জ। আর, বাডি ফিল্মের কাঠামোর মধ্যে বাডি ফিল্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাওয়ার কাজটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ।
আপনি বলতেই পারেন, “সে তো গল্পেরই গুণ!” আমদাবাদ শহর, ক্রিকেট, ভূমিকম্প, দাঙ্গা এ সব তো উপন্যাস থেকেই পাওয়া। ঠিক। কিন্তু ছবিটা দেখলে আর এ কথা বলবেন না। প্রথমত, উপন্যাসের সঙ্গে ছবির গল্পে তফাত আছে। ছবিটা গোবিন্দর জীবনের তিনটি ভুল চিহ্নিত করার আখ্যান নয়।
দ্বিতীয়ত, চেতন-ফ্যানেদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েই বলছি ‘থ্রি মিসটেকস...’ মহান তো নয়ই, বেশ মাঝারি মাপের লেখা। তর তর করে পড়ে যাওয়ার গতি-সুখটুকু ছাড়া আর বিরাট কিছু ছিল না তার মধ্যে। ‘কাই পো চে’ বইটাকে ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে অনেক দূর। কোনও রকম বাহুল্য ছাড়াই।
গোটা ছবি জুড়ে আশ্চর্য সংযম দেখিয়েছেন অভিষেক। একই ছবিতে ভূমিকম্প এবং দাঙ্গা অথচ স্পেক্ট্যাকল তৈরি করার কোনও লোভ চোখে পড়ল না। বলবেন তো, ফিল গুড ফ্যাক্টর বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই এই স্ট্র্যাটেজি? সেটা আংশিক সত্য হতে পারে, সবটা নয়। কারণ, সংযমটা আরও অনেকগুলো স্তরে আছে। ইমোশনাল আর সেন্টিমেন্টালের দূরত্ব বজায় রাখার সংযম। কড়া দেশপ্রেমের ডোজ এড়িয়ে চলার সংযম। বিনোদন মানেই শুধু ফুর্তি বা থ্রিল, এমনটা না-ভেবে এগোনোর সংযম।
সংযম না কি সাহস? কী বলা উচিত একে? বলিউডের বিগ ব্যানার ছবিতে গুজরাত দাঙ্গা আগে আসেনি (পরজানিয়া বা ফিরাক-এর মতো ছবিকে নিশ্চয়ই মূল ধারায় ফেলা হবে না)! এই ছবিটা এল তো এল, এমন সময়ে এল, যখন মোদীর গুজরাত দাঙ্গার জনস্মৃতি মুছে ফেলতে মরিয়া! ছবিতে হিন্দুত্ববাদী দলটির কাল্পনিক নাম, ‘ভারতীয় জনহিত সঙ্ঘ’! সাহস নয়?
গল্প শুরু হচ্ছে নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায়। অমদাবাদের তিনটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, ঈশান-গোবিন্দ-ওমি। ঈশান (সুশান্ত সিংহ রাজপুত) রগচটা, ইম্পালসিভ। ওমি-ও (অমিত সাধ) ইম্পালসিভ, তবে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কথা শুনে কাজ করে। গোবিন্দ (রাজ কুমার যাদব) শান্ত, অঙ্কের মাথা পরিষ্কার। ব্যবসাবুদ্ধি আছে। ওরা ঠিক করে, খেলাধুলোর সরঞ্জামের দোকান দেবে। সঙ্গে ক্রিকেট কোচিং। ক্রিকেট ভালবাসে তিন জনেই। তবে ঈশানের ক্ষেত্রে ক্রিকেটটাই ধ্যান-জ্ঞান। সে-ই খুঁজে বার করে বাচ্চা ছেলে আলিকে (দিগ্বিজয় দেশমুখ)। আলির ব্যাটিং দেখে ঠিক করে, তাকে বড় ক্রিকেটার বানাবে। গোবিন্দ ব্যবসা দাঁড় করানোর দায়িত্ব নেয়। রাজনীতি করা বিট্টু মামা-র (মানব কল) কাছ থেকে টাকা জোগাড়ের হ্যাপা সামলায় ওমি।
সুশান্ত-রাজ কুমার-অমিতের রসায়ন লা-জবাব! ওদের দেখলে কে বলবে, ওরা হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে একসঙ্গে নেই? কে বলবে যে, পাড়ার মাঠে-ক্লাবঘরে-চায়ের দোকানে-ক্যারমের আসরে এদের সঙ্গে আমাদের রোজ দেখা হয় না?
আবার অভিষেকের সাহসকে সেলাম! সুপারস্টার তো দূরে থাক, প্রায় নন-স্টারদের নিয়ে এই রকম একটা অভিনয়-প্রধান ছবি করে দেখিয়ে দিলেন! ভাগ্যিস! এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের সঙ্গে স্টার-ইমেজ জড়িয়ে নেই বলেই ওদের ঘরবাড়ি-ঘামে ভেজা শার্ট-সাধারণ মানের টিভিতে হাঁ করে ম্যাচ দেখার মুহূর্তগুলো এতটা বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। সুশান্ত অসম্ভব ভাল। আর, রাজকুমারকে দেখে মনে হবে ‘গোবিন্দ’ হওয়ার জন্যই জন্মেছেন! আগেও যে ক’টা ছবিতে ওঁকে দেখেছি, ভাল লেগেছিল। ‘কাই পো চে’ চোখের পাতা ফেলতে দিল না! এঁদের তুলনায় অমিত খুব সামান্য হলেও দুর্বল। ভাল লাগে ঈশানের বোনের ভূমিকায় অমৃতা পুরীকে।
ভাল লাগে অনয় গোস্বামীর জৌলুসের বাহুল্যবর্জিত ক্যামেরা, দীপা ভাটিয়ার কাঁচি, অমিত ত্রিবেদীর সুর। দরজার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো রোদের উপরে গড়িয়ে আসা কাচের গুলির মতোই মসৃণ! হ্যাঁ, এটা বলা যেতে পারে যে, একটু বেশি মসৃণ! পুবালি-চেতন-অভিষেক-সুপ্রতীকের চিত্রনাট্যে যেখানে যা ঘটা উচিত, যেখানে যে ভাবে মন ভেজা উচিত, ঠিক তেমনটিই হয়। কিন্তু সেটা তো বলিউডের এই জাতীয় ছবির ধর্মই, তাই না?
আর একটা প্রশ্ন শুধু। বয়েজ উইল বি বয়েজ, এ তো জানা কথা। মেয়েদের বন্ধুতার গল্পটা লেখা হবে কবে? ‘কামিং অফ এজ’য়ের গল্পটা আদ্দেকই থেকে যাচ্ছে যে! চাঁদের ও পিঠে আলো কবে পড়বে, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে! আপাতত আকাশে উড়ুক ‘কাই পো চে’! তাকে ভো-কাট্টা করে, কার সাধ্যি? |