অঞ্জন-ব্যঞ্জন
চিনে নিল তারে
চিন-ভারত যুদ্ধের আগে না পরে ভারতে চাইনিজ খাবারের আমদানি হয়েছে, ইতিহাস বলবে। আমাদের আজকের লেখা চাইনিজ রসনার ভারতজোড়া ভূগোল নিয়ে। ব্রিটিশ বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আমরা যতই গা-গরম করি, খেয়াল করে দেখবেন কেমন নিঃশব্দে চৈনিক আগ্রাসন ভারতবর্ষকে গিলে খেয়েছে। চাইনিজ মোবাইল থেকে চিকেন মাঞ্চুরিয়ান উদাহরণ অজস্র। সম্প্রতি বারাণসী গিয়েছিলাম। দশাশ্বমেধ ঘাটে চাউমিন বিক্রি হচ্ছে দেখে আমার বিশ্বাস আরও পোক্ত হল। কয়েকজন আমিষাশী সাধুবাবাকে কাঁটা-চামচ দিয়ে চিলি-চিকেনও খেতে দেখলাম। এই না হলে ভারতবর্ষ! এবং প্রায় একই নিঃশ্বাসে বলতে পারি, এই না হলে চাইনিজ! আমি নিশ্চিত, সাংহাই বা বেজিং-এ বসে সেখানকার দেশজ কেউ পুরি-সব্জি খাবেন না।
কলকাতার কথাই ধরুন। আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ার মোড়ে কটা রোলের দোকান ছিল? আর আজ, হালিশহর থেকে হাসনাবাদ, জলপাইগুড়ি থেকে জয়রামবাটি, সন্ধে হলেই বাঙালির জিভে চাইনিজ। আশ্চর্য হই না যখন দেখি ডিনার এখন অনেক বাঙালিই ভাতের বদলে চাউমিন দিয়ে সারছেন। মজার ব্যাপার হল, এই ব্যাপারটা শুধু বাংলা-কেন্দ্রিক নয়, কট্টর দক্ষিণ ভারতেও ধীর পদক্ষেপে প্রবেশ করেছে চৈনিক খানা।
কসমোপলিটান বেঙ্গালুরুর কথা ছেড়েই দিলাম, দক্ষিণ ভারতের অনেক ছোট শহরেও আজ চাইনিজ রেস্তোরাঁর জমজমাট পসার।
আসলে, চাইনিজ রেসিপির মতো সহজ ও সহজপাচ্য আর দুটো নেই। এর বিশ্বজোড়া বিস্তারের পিছনে রহস্য এটাই। যে কারণে, পাড়ার মোড়ে পল্টুদা থেকে পাঁচতারা হোটেলের শেফ, দু’জনের কাছেই ব্যাপারটা জলবত্‌ তরলম্‌। অনেক বাঙালি বাড়িতে, নিজের কানে শোনা, রান্নার মাসির ইন্টারভিউ নেওয়ার সময়, বাড়ির বৌ জিজ্ঞাসা করছেন, ‘চাউমিন বানাতে পারো তো, আমার বাবু কিন্তু আর কিছুই খায় না!’ বাচ্চাদেরও ফেভারিট এই চাইনিজ।
ডাল-ভাত মেখে খাওয়ার পরিশ্রমের থেকে এক একটি নুডলস খাওয়া তাদের কাছেও সহজতর। দু ’মিনিটের ম্যাগির কদর আর বাজার সাধে কি বেড়েই চলেছে।
চাইনিজের ভারতীয়করণও একটা মজার ব্যাপার। মানিকতলার মোড়ে চাউমিনে বাদাম মেশে, ম্যাঙ্গালোরে দেখেছি কারি পাতা। এমন কি, যে বেনারসি চাউমিনের কথা বলে শুরু করেছিলাম, তার স্বাদ কিন্তু যতটা উত্তর ভারতীয়, ততটা আদৌ চাইনিজ নয়। হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই-এর যে স্লোগান জওহরলাল নেহরু দিয়েছিলেন, আজ যেন আমাদের খাবারের মেনুতে তা সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রসঙ্গে, কলকাতার ট্যাংরার কথা না এলে অন্যায় হবে। মজা হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক শহরেই কিন্তু এ রকম চিনে পাড়া আছে। কিন্তু কলকাতা এই পাড়াকে যে ভাবে আপন করে নিয়েছে, সারা বিশ্বেই তার তুলনা মেলা ভার। শুধু কি তাই, টেরিটিতে চাইনিজ ব্রেকফাস্টও তো কলকাতা ঘুরতে আসা বিশ্ববাসীর কাছে অবশ্য দর্শনীয়।
তো, এই ভাবেই একটু-একটু করে আমাদের হাঁড়ির খাবারে, বাড়ির খাবারে ভাব জমিয়েছে চাইনিজ আহার। চিনের চেয়ারম্যান আজ আমাদের চেয়ারম্যান না হলেও, বলাই যায়, চিনের চাইনিজ আমাদের চাইনিজ। আর রেড বুক হয়ে গেছে বাঙালির মেনুকার্ড!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.