ব্যাগ গুছিয়ে...

বসন্তের বহ্নিমালা
রাইকা হিলের যাত্রাপথে প্রথম গ্রাম পাহাড়গোড়াটি প্রায় নিরঙ্কুশ শবর গোষ্ঠীর। জঙ্গলের দাপট নেই এ দিকে ততটা। তবে চারিদিকের প্রকৃতি পাহাড়ি ঢেউয়ে উদ্বেল। জানিঝোরা, বড়ন্যাশা, সেজুনাচা, বুলনগচা, ভেড়াবুরু পাহাড় হিসেবে খুব শাহেনশাহ নয়। সময়টা ফাল্গুন। হিমেল বাতাসে উষ্ণতার নরম ময়াম মাখানো। ফলত বেশ আরামপ্রদ যাত্রা। পাহাড়গোড়া পেরিয়ে যেতেই দু’পাশে খুচরো জঙ্গল এসে পড়ল। শীত ঋতু তাকে নিঃস্ব করে বাউল বসনে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। পায়ের কাছে স্তূপাকার খরখরে পাতার পোশাক। ফলে জঙ্গল অনেকটা দৃশ্যমান। তার মধ্যে গলায় কাঠের ‘ঠরকা’ বাজিয়ে গো-পাল ছড়িয়ে আছে। দূরে গাছের পাতলা ছায়ায় অলস বসে গোঠ বালকেরা ছোট তিরিয়তে (বাঁশিতে) ঝুমুর লাগিয়েছে। মধ্যাহ্নের জঙ্গলে একটা মন কেমনের গন্ধ থাকে এই সময়টায়। তাকে আরও উসকে দেয় ঘুঘুর ক্রমাগত বিরহ-রোদন।
ঘাঁটিউলি গ্রামটি ছেড়ে এসেছি আগেই। জঙ্গলের মাঝে ছোট ছোট গ্রামের স্টিকার সরে যায় ক্রমশ। চারিদিকে পাহাড়ের গামলায় ছোট্ট জনহীন গ্রাম কুশবনিতে নেমে পড়ি। এমন এক গোপন অজ্ঞাতবাসে জীবনের কিছুটা পরমায়ু খুইয়ে গেলেও কত কী অর্জন হয়, ভাবতে থাকি। রাঙিধরা, বড়ন্যাশা, সেজুনাচা, বুলনগচা পাহাড়ের ফাঁদে ছোট ছোট হোম স্টে-র পত্তন হলে স্থানীয় মানুষগুলিও অভাবের জাল কেটে বেরিয়ে আসে। পলাশের ‘ব্লাড রুট’ ধরে জঙ্গলের ভরা জোয়ারে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। দু’ধারে যেন আততায়ীর হাতে চাপচাপ রক্তে রাঙা বনাঞ্চল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমলা ধাতকি ফুল, কোথাও সাদা হাটবাহার মিষ্টি গন্ধ লুটিয়ে বেড়াচ্ছে। শালের কচি পাতাও গন্ধ উগরায়। আর থেকে থেকে ডাকে বুড়ো মৌকাল পাখি। ডাকছে টিরহন।
অবিস্মরণীয় এক ধুলোটে যাত্রা ফায়ারলাইন ধরে। বহু দূরে বসন্তের পোস্টম্যান ভাসিয়ে দিয়েছে তার ডাক, কু-উ-উ-উ! বৈরাগী বাতাসের রাঙা আঁচলে ঢাকা পড়ছে ছোট ছোট গ্রাম ঘাঘড়া, কুমড়া। চিংরির ঝোপে রক্তদানা ফুলগুলো ঝরে পড়ে বাতাসের ঝাপটায়। ফুটে আছে হলুদ গলগলি। শ্রীগাড়ু পেরোল। দেহাতি বালিকা থমকে দেখে আমাদের ধূলিযান। লাল ফাগ তাকেও খানিক রাঙিয়ে দিয়ে বনের পথে নেচে বেড়ায়।
ডুংরিডিতে এসে গাড়ি থেকে নামতে হল। এত ক্ষণে জঙ্গলের কিছুটা ছাড় মিলেছে। বেশিটাই জারাডালি আর ভরভরি লতার ঝোপ। কোথাও বা ভুররু ফুল ফুটে আছে। বসন্ত কুসুমে কুসুমে তার চরণচিহ্ন রেখে যায় সারা বনমহলে। সামনেই বড়সড় এক তড়াগ। বেশ খোলামেলা পরিবেশটি। মাথার উপরে ঢালাও নীল সায়রে ইতস্তত ভেসে বেড়ায় শ্বেতশালুক মেঘগুলি। আকাশের ট্র্যাক ধরে উড়ে উড়ে হারিয়ে গেল একগুচ্ছ বুনো হাঁস লুরসিং পাহাড়ের ফাঁকে। অদূরে দেখা দিল পাহাড়ের ঢেউ। তড়াগে জাল ছুড়ে মাছ ধরছিল স্থানীয় গ্রামবাসী। আমাদের চালকটি হঠাত্‌ হেঁকে ওঠেন, “কী ধরছ হে? আমাকেও দাও এক-দুটা!” এক জন বলে, “মাছ লিঁবে কি?” “দিলে লিঁবহ-ই বটে।” “তা হলে ধর।” ছুড়ে দেয় সে একটি গোল্ডেন মৃগেল। চালকটি শূন্যে ছোঁ মেরে লুফে নেয় টগবগে মাছটিকে। ওজনে প্রায় ৭০০ গ্রাম অবশ্যই। গাড়ির পিছনের ডালা খুলে চালান করে এসে বলে, “স্যর, রাইকা প্রায় এসে পড়েছি।” মাছের দাম দেবে না? সে রীতিমতো বিস্মিতই, “দাম! কাকে দেব! এ তো সরকারি তালাও।” অর্থাত্‌ সরকার মানেই জনগণ। সে আপন হিস্যাটা লোকটির থেকে বুঝে নিল এবং হৃষ্ট চিত্তেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
এ বার গন্তব্য রাইকা। সামনে শৃঙ্খলিত পাহাড় আর জঙ্গল। সরকার বুনে দিয়েছে নেপিয়ার, দীননাথ ঘাস, কলা, ডুমুর। হাতির পছন্দের মেনু। বনকর্মীদের মুখে অনেক বারই শোনা এই রাইকা হল দলমা থেকে হাতি নামার গেটওয়ে। এখান থেকে ওরা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার মাঠে ফসল পাকলে দলমায় খবর হয়ে যায়। বড় দলে এসে ধান প্রাণ চটকে, প্রশাসনকে হেনস্তা করে ফিরে যায় ঝাড়খণ্ডে। এই অপারেশন জারি থাকে চৈত্র-ফাল্গুন জুড়ে।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি, ধাপে ধাপে পাহাড়শৃঙ্গ গাড়েডুংরি, রাইকা (উচ্চতম), লুরসিং এবং সব শেষে টুয়াডুংরি। পাহাড়ের পাদদেশে এক জলাশয়। হাতি নেমে এসে দীননাথ, কলা, নেপিয়ারে পেট ভরিয়ে জলপান শেষে নেমে পড়ে অপারেশন প্যাডিল্যান্ড-এ। বসন্তের দুপুরে নিশ্চুপ বন। পলাশের ডালে আগুনের হুলা (মশাল) জ্বলছে। গাছের টং থেকে চকিতে নেমে এল এক ভূমিজ যুবক। জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। যুবতীর শরীরটি কাজল-পালিশ। চোখের ভাষায় শঙ্কা। পুরুষটির সাঁই-জওয়ান শরীর। নাম বলল ভূতনাথ সর্দার। সঙ্গে তার স্ত্রী, কালিন্দী।
এখানে কোথায় থাকা হয়?
ভূতনাথ বলে, এই তো লাগালাগি গাঁ, কেশরা।
এ তো হাতির মুলুক ভাই!
তার নির্বিকার উক্তি, আমরা তো একেই সাথ থাকাবসা করি। হাতি ছিল ত এখানে, দু’দিন হল ঘুরেছে বকডুবার জঙ্গলে।
এরা খেটেল মানুষ। যেখানে কাজ, সেখানেই এদের ভাত। বছরে পাঁচ মাস বর্ধমানের মাঠে নামালি খাটতে যায়। বাকি সময়টা? ভূতনাথের কথা থেকে জানা যায়, বাকি সময়টা ওরা ‘বন-ধরা লঁক’। এই বনটাই মহাজন। গরমকাল থেকে শীতকাল পর্যন্ত সে দেয় কেঁদ, পিয়াল, মাদাল, বনআলু, ভুররু, রকমারি ছাতু (মাশরুম)। সে হরেক ছাতুর গুণাগুণ হাসতে হাসতে পেশ করে। তদুপরি গোসাপ থেকে ভাম, গাছবিড়াল, বনরুই (প্যাঙ্গোলিন), জমরু সাপ খাদ্যতালিকা থেকে কিছুই বাদ দেয় না! আমরা শুনি আর হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি সর্বভূক এই মানুষটির দিকে!
গাছে ফুটেছে বনকটহর। মোরামে ঝরছে মহুলকুঁড়ি। সজনেগাছে ঝাঁপিয়ে এসেছে ফুল। ‘কুব কুব’ ডেকে চলেছে কুবো পাখি। তারই মধ্যে ছড়িয়ে থাকা শবরপাড়া, ভূমিজটোলা, মহালিদের বাখুলিতে মানুষের সাড়া নেই। এখানে জীবন আছে, স্পন্দন নেই। হরিজন সমাজ আছে, স্বপ্নহীন। এক দিকে প্রকৃতির এই বহ্নিমালা, পাশেই ক্ষুধার দাবানল। দুইয়ে মিলে রাইকার বসন্ত-সফর রোদনে ও আনন্দে পূর্ণ-অপূর্ণে ভরে ওঠে!

ছবি : রঞ্জন মুখোপাধ্যায

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ট্রেনে গালুডি স্টেশনে নেমে, গাড়িতে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে যাবেন।
কখন যাবেন
বান্দোয়ানে একটি চমত্‌কার বনবাংলো আছে।
কী ভাবে ঘুরবেন
বাজারে গাড়ি পাবেন ঘোরার জন্য।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.