|
|
|
|
বাঙালি ভিতে সাম্রাজ্য গড়ে এগোচ্ছেন মানিক |
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
কোথায় যাচ্ছেন?
সামনে!
মাত্র একটি শব্দে এই জবাবটিই দিতে ভালবাসেন মানিক সরকার। যাঁর নামের আগে ‘দেশের একমাত্র’ শব্দটা এখন লেপ্টে গিয়েছে! দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী!
পরপর পাঁচ দফার মধ্যে চার বারই ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল তাঁর হাত ধরে। মানিক এখন বড় ইনিংসের খাতায় নাম লেখাতে চলেছেন। আসলে যা বলতে ভালবাসেন, তা-ই ঘটছে মানিক-রাজে। ‘সামনে’ই এগোচ্ছে তাঁর সরকার।
পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। চলনে-বলনে মার্জিতরুচি বাঙালিয়ানা। এক নজরে কোথায় যেন জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ঔদ্ধত্য বা উন্নাসিকতা কোনওটাই তাঁর নেই।
ত্রিপুরার ৬৮ শতাংশ বাঙালি তাঁকে সমর্থন উজাড় করে দেয়। আবার ৩২ শতাংশ উপজাতি ভোটেও তিনি অন্য কারওকে ভাগ বসাতে দেন না। পরপর দু’টি নির্বাচনের ফলাফলে সেই ধারাবাহিকতা স্পষ্ট। তাঁর দলীয় সহকর্মীরা তাই বলেন, বাঙালি ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে উপজাতিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কার্যকরী মিশ্রণ ঘটাতে তাঁদের সেরা বাজি ৬৪ বছরের সদাহাস্যময় এই বাণিজ্যের স্নাতক। জনসমর্থন আদায় করে আনার
ক্ষেত্রে তিনি আদর্শ সেলসম্যান। একই রকম কুশলী তাঁর রাজ্যের জন্য কেন্দ্র থেকে যে কোনও রকম সহায়তা আদায়ের সময়েও।
তিনি এটাও বিশ্বাস করেন, ত্রিপুরার বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। মানিক বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত করতে পারলে ত্রিপুরাকে উত্তর-পূর্বের প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। আমাদের দেশের লুক-ইস্ট পলিসির জন্যই তা কাজে আসবে।”
পরম্পরাগত ভাবে বাঙালি ভোটের সমর্থন নিয়ে ত্রিপুরার রাজ্যপাটে অভিষেক হয়েছিল মানিকের। দিনে দিনে বাঙালি ভোট আরও সংহত করে এখন উপজাতি মানুষের মন জয়েও এগিয়ে চলেছে মানিকের সরকার। উপজাতি এলাকার জন্য স্বশাসিত পরিষদের (এডিসি) সর্বশেষ ভোটে বিরোধীশূন্য জিতেছিল বামফ্রন্ট। এ বার বিধানসভায় উপজাতি এলাকায় কংগ্রেসের জোটসঙ্গী আইএনপিটি-কে শূন্যে নামিয়ে আনতে সফল হয়েছে বামেরা।
বস্তুত, রাজ্যে বাঙালি-উপজাতি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে নৃপেন চক্রবর্তীর এই শিষ্যের সাফল্যের সূচনা হয়েছিল বাঙালি রসায়নে ভর করেই। নৃপেনবাবুর দশ বছরের রাজত্বের শেষে পাঁচ বছরের জন্য উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস-টিইউজেএস জোট সরকার। পাঁচ বছরে সন্ত্রাসের ঘনঘটায় পরের ভোটেই তাদের বিদায় এবং মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে সিপিএমের উপজাতি নেতা দশরথ দেব। দলের অন্দরে তাঁকে নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে তার পরের নির্বাচন (১৯৯৮) থেকেই রাজ্যের ভার মানিকের হাতে। সেই থেকে লাগাতার চলছে নৃপেন-শিষ্যের ইনিংস। এখন থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছে, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পাঁচ বার বাম সরকার গড়ার রেকর্ড মানিকের হাতেই শেষ পর্যন্ত ভাঙে কি না!
বাঙালি জনসমর্থনের ভিতে শুরু করে ক্রমে যে ইমারত
মানিক গড়ে তুলেছেন, তাতে সহায়ক হয়েছে তাঁর ভাবমূর্তি। তাঁর সততা। তাঁর ‘আমাদের লোক’ হয়ে মিশে যেতে পারার ক্ষমতা। তুলনায় কারও মনে আসতেই পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।
মানিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেও মাত্র কয়েক হাজার টাকা। পৈতৃক বাড়ি দিদিকে দিয়ে দিয়েছেন। আগরতলার সরকারি আবাসনই মাথার উপরে একমাত্র ছাদ। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন চাকুরে স্ত্রীকে কখনও সরকারি গাড়িতে সওয়ার হতে দেখেননি কেউ। কথা বলতে চাইলে কাউকে ফেরান না। এ বারের বিধানসভা ভোটের প্রচারেও তুমুল ব্যস্ততার দিন শেষে মেলার মাঠের দলীয় দফতর থেকে বাড়ি ফেরার আগে দরজায় দাঁড়ানো কেরলের অনুরাগী বৃদ্ধের কথা মন দিয়ে শুনে নিতে ভোলেননি।
তা বলে কি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত মানিকের গায়ে কোনও দাগ নেই? নিন্দুকেরা বলেন, অল্প অল্প আছে! নিজে অসম্ভব সৎ। কিন্তু তাঁর চার পাশের কিছু লোকজনের অন্যায় দেখেও সব সময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হন না। তাঁর জমানায় ত্রিপুরায় পুলিশের বহু নিয়োগই নাকি সিপিএমের তালিকা মেনে হয়েছে। সিপিএমের এক সর্বভারতীয় নেতার কথায়, “ব্যবহারে উনি ভীষণ ভাল। সব সময় মুখে হাসি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আদ্যন্ত স্তালিন!” নিন্দুকদেরই কেউ কেউ বলেন, অন্য সব গাফিলতি ব্যবহারের মাধুর্য দিয়ে ঢেকে রাখতে চোস্ত মানিক!
মানিক অবশ্য বলছেন, “ভাল ব্যবহার করতে অসুবিধা কী আছে? ব্যবহার জিনিসটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। আমার কাছে কেউ এলে আমি কি সব জিনিসে তাকে সন্তুষ্ট করতে পারব? আমার বিরুদ্ধেই যদি অভিযোগ নিয়ে আসে, আসুক না! কথা শুনতে হবে। এটা করতে না-পারলে কমিউনিস্ট পার্টি করে কী লাভ?” কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ? মানিকের দাবি, তিনি কখনও ক্ষমতাকে মাথায় চড়তে দেন না। তাঁর কথায়, “আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে, এটা ভাবলেই তো হয়ে গেল! ক্ষমতাই যদি থাকত, তা হলে কত সমসার সমাধান করে দিতাম!” মানিকের মন্ত্র “জীবনযাপন, চালচলন ঠিক রাখতে হবে।”
ঠিকই। নিজের জীবনচর্চায় প্রশ্নের অবকাশ রাখেননি মানিক। সকালে উঠে শরীরচর্চা। ভিন্ শহরে গিয়ে উড়ান ধরার তাড়া থাকলেও এই নিত্যকৃত্যে ছেদ নেই। দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় অবশ্যই পার্টি অফিস। নেশা বলতে ক্রিকেট (কলেজ জীবনে মাঠেও নেমেছেন), শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং অল্পসল্প সিগারেটে সুখটান। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো উন্নাসিক নন। বুদ্ধবাবুর মতো উদ্যোগী হতে গিয়ে হাতও পোড়াননি। বরং, অনেকটা প্রয়াত বসুর কায়দায় স্থিতাবস্থা নিয়ে চলেছেন এত দিন।
কী বলেন বিরোধীরা? প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সমীররঞ্জন বর্মনের মতে, “কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়। আর মানিক সরকার হেলমেট পরে তদারকি করে বাহবা কুড়োন!” রাজ পরিবারের কংগ্রেস নেতা, মহারাজ প্রদ্যোতবিক্রম ‘কিশোর’ মাণিক্য দেববর্মার বিশ্লেষণে, “কমিউনিস্ট নেতারা বিরোধীদের সম্পর্কে কুৎসিত আক্রমণ করেন, এই রকম অনেক নজির ইতিহাসে আছে। মানিকবাবুকে ধন্যবাদ, তাঁর জন্যই ত্রিপুরায় বামেরা এই পথে নেই। এখন ওঁদের আক্রমণ অনেকটাই রাজনৈতিক।”
কী বলেন মানিকের দলের নেতারা? সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের বক্তব্য, “এই যে আমরা বিকল্প নীতির কথা বলি, মানিকের সরকার ত্রিপুরায় সেটা কাজে করে দেখিয়েছে।” দলে কারাটের পছন্দের লোক মানিক। আবার ভি এস অচ্যুতানন্দনকে বাঁচাতে পলিটব্যুরোয় লড়তেও পারেন! জরুরি অবস্থার সময় কলকাতায় একসঙ্গে দিন কাটিয়েছেন রবীন দেবের সঙ্গে। রবীনবাবুর কথায়, “আমরা সহযোদ্ধা! তখন ত্রিপুরায় বাদল চৌধুরী (এখনও মানিকের বিশ্বস্ত সতীর্থ) ছাত্র সংগঠনের সভাপতি, মানিক সম্পাদক। তার পর থেকে আত্মীয়তার জায়গায় এসে গিয়েছি। মানিক অনেক এগিয়েছে, বড় হয়েছে। কিন্তু কাউকে ভোলেনি!”
হক কথাটা বলছেন পলিটব্যুরোর সতীর্থ সীতারাম ইয়েচুরি। “মানিক সরকার এমন একটা লোক, যার সঙ্গে ত্রিপুরার মানুষ নিজেদের মেলাতে পারে। মাটির মানুষ। সহজ কথা সাধারণ ভাবে বলেন। কোনটা করতে পারা যাবে, সেটাই বলেন। এই সাধারণত্বই আসল কথা।”
সাধারণ হয়েই ভাল আছেন
এবং সামনে যাচ্ছেন বাম মুকুটের একমাত্র ‘মানিক’!
|
শপথ বুধবার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • আগরতলা |
বুধবার শপথ নিচ্ছে ত্রিপুরার নতুন সরকার। রাজভবনে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। রাজ্য বামফ্রন্টের এক বৈঠকে আজ এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের এ কথা জানান ফ্রন্ট চেয়ারম্যান খগেন দাস। নতুন মন্ত্রিসভায় কারা থাকবেন, সে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করবেন বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। খগেনবাবু বলেন, বামফ্রন্ট কমিটির তরফে একটি বিজয়োৎসব হবে ৭ মার্চ। শহরের আস্তাবল ময়দানে দুপুর ২টোয় শুরু হবে এই বিজয়োৎসব। |
|
|
|
|
|