|
|
|
|
অগ্নি-বিধির তোয়াক্কাই নেই অধিকাংশ বড় বাজারের |
অশোক সেনগুপ্ত |
‘ফায়ার ড্রিল’-এর বালাই নেই। নেই ‘স্মোক অ্যালার্ম’। আগুন লাগলে তার চটজলদি মোকাবিলার পথ জানা নেই কর্মীদের। সরকারি বা বেসরকারি— শহরের অধিকাংশ সুপার-মার্কেটের হাল এমনই। অগ্নিকাণ্ড হলে এই সব বাজারের হাল হতে পারে শিয়ালদহের সূর্য সেন মার্কেটের মতো বা তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ।
প্রায় আড়াই দশক আগে আগুনে ভস্ম হয়ে যায় নিউ মার্কেটের একাংশ। ওই জমিতে ২২ বছর আগে পুরসভা ‘নয়া প্রকল্প’ তৈরি করে। ২৫ বিঘা জমিতে ভূগর্ভে একটি, উপরে তিনটি— মোট চারটি তল। সেগুলিতে সাড়ে ছ’শো দোকান ছাড়াও আছে একাধিক বেসরকারি অফিস। শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ‘ফায়ার বক্স’ বেশ ক’টি আছে। সে সবে জলের পাইপ নেই। অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র রয়েছে কয়েকটি মাত্র। অগ্নিকাণ্ডে জল সরবরাহের লক্ষে লোহার পাইপ বসানো হয়েছিল। তার কিছু জায়গা ভাঙা। সারিবদ্ধ দোকান দাহ্য পদার্থে ঠাসা। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের তার মাকড়সার জালের মতো পাকানো। মাটির নীচে জলাধারের একটি বড় অংশ অকেজো। সেখানে জলের বদলে ইট-পাটকেল। বহু বছর না-খোলায় জলাধারের ঢাকনাগুলি চেপে বসে গিয়েছে। আগুন লাগলে জলের জোগান নিয়ে দমকল সমস্যায় পড়বে। |
নিউ মার্কেট |
শুধু বাক্সই রয়েছে। নেই অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র। |
বৈদ্যুতিক তারের এই জাল যেন সাক্ষাৎ বিপদ-সঙ্কেত। |
|
দোকানিদের সংগঠনের সভাপতি দেবু ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “নিরাপত্তার অভাবজনিত এ সব বিষয় পুরসভাকে অনেক বার জানানো হয়েছে। কোনও কাজ হয়নি।” যুগ্মসচিব প্রদীপকুমার সাউয়ের অভিযোগ, “ক’দিন আগে মেয়র-পারিষদকে লিখিত ভাবে আমরা এ সব জটিলতার কথা জানিয়েছি।” কেন পুর-কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হচ্ছেন না? মার্কেটের সুপারিন্টেন্ডেন্ট গৌর ঘোষ সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তাঁর সাফাই, “অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের সংখ্যা বাড়ানো হবে। একটি গভীর নলকূপ কিছু দিন আগে বসেছে। সেটির সঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলাধারটি যুক্ত করা হবে।” আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জল সরবরাহের বিশেষ পাইপগুলিও মেরামতির আশ্বাস দেন তিনি।
পুরভবনের প্রায় নাকের ডগায় ফিরপো মার্কেটে বড় আগুন লাগে ২০০২-এর ২৩ এপ্রিল। প্রায় এক দশক বাদে কতটা ফিরেছে ওই বাজারের হাল? দোতলা রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। প্রথম তলে যাতায়াতের তিনটি পথই অপরিসর। আপৎকালীন ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। কেন এই হাল? বাজার কমিটির সম্পাদক এস এস দিদওয়ানিয়ার বক্তব্য, “এই মার্কেটের লিজের মেয়াদ ২০১০-এ শেষ হয়েছে। নতুন করে লিজ হচ্ছে না। হলে যাঁরা দায়িত্বে আসবেন, তাঁরা এ সব দেখবেন।” লিজের পুনর্নবীকরণ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মূল মালিক দীপেন মল্লিক বলেন, “যাঁদের লিজ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে বাড়ির দখল পাচ্ছি না। আমরা তাই অপারগ। দোকানিদের অনুরোধ করেছি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ওঁদের নিজেদেরই করে নিতে হবে।”
২৩ বছর আগে এ জে সি বসু রোড সংলগ্ন লি রোডে তৈরি হয় শপিং মল ‘বৈভব’। নীচের তিনটি তলে দোকান। উপরের দু’টি তলে অফিস। ভবনটি তৈরির কিছুকাল বাদেই অচল হয়ে যায় সেখানকার চলমান সিঁড়ি। আর চালু হয়নি। স্মোক ডিটেক্টর নেই। অগ্নি-মহড়া হয় না। বাড়ির কেয়ারটেকার পরিমল গোস্বামী বলেন, “পুরো ভবনটিতে দোকান হবে ভেবে এসক্যালেটর বসানো হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল এসক্যালেটর লাগছে না। তিনটি লিফ্টে কাজ ভাল ভাবে হচ্ছে।” স্মোক ডিটেক্টর এবং অগ্নি-মহড়ার ব্যাপারে কোনও সদুত্তর মেলেনি তাঁর কাছ থেকে। বলেন, “পুর-কমিশনার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। সব কিছু পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |
বৈভব মার্কেট:
যাওয়া-আসার পথ
বন্ধ করে বসেছে এসক্যালেটর। |
ফিরপো’জ মার্কেট:
অপ্রশস্ত প্রবেশপথ। |
|
নিরাপত্তায় আরও বেশি খামতি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বালিগঞ্জ নিউ মার্কেটে। ২২ বছর আগে গড়িয়াহাটে তৈরি হয় ওই ভবন। একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য বসানো হয় চলমান সিঁড়ি। চলছে একতলা থেকে দ্বিতল পর্যন্ত। অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র যৎসামান্য। সারি সারি কাপড়ের দোকান। মোট দোকানি ৭১ জন। মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সম্পাদক সানি সাহার বক্তব্য, “এই ছোট ছোট দোকানে আর কী সতর্কতা নেব, বলুন?” ভবনের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ তলে কল সেন্টার, প্রশিক্ষণ-সংস্থার মতো বেসরকরি অফিস। প্রবেশ-প্রস্থানের সরু দরজা। দু’টি ছোট্ট লিফ্ট। এই তিনটি তলে হাতেগোনা অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র। ষষ্ঠ তল থেকে নামার সিঁড়ি বন্ধ। ওই তলে আগুন লাগলে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম।
শহরের আপাত-অভিজাত মার্কেটগুলিরই যদি এই হাল হয়, তা হলে আমজনতার বাজারগুলির হাল যে আরও খারাপ হবে, বলাই বাহুল্য। কেন এই অবস্থা? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সরকারের নির্দেশ শহরের সরকারি-বেসরকারি যত বাজার আছে, সব সমীক্ষা করতে হবে। কোথায় কী ঘাটতি আছে, তা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাজার টাস্ক ফোর্সের বৈঠক হয়। ঠিক হয়েছে, নজরদারি কমিটির পাশাপাশি প্রতিটি বাজার সমিতি নিজের বাজারের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা কী অবস্থায় রয়েছে, সে দিকে নজর রাখবে। শহরের বিভিন্ন বাজারে বিদ্যুতের অবস্থা কী রকম, তা খতিয়ে দেখবে নজরদারি কমিটি। ওই কমিটিতে অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতর এবং এনভিএফ কর্মীরাও থাকবেন। বাজার টাস্ক ফোর্সের সদস্য এবং ফোরাম অফ ট্রেডার্স অরগানাইজেশনের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ কোলে এ কথা জানান। তিনি বলেন, “যে সব বাজারে সমিতি নেই, সেই সব বাজারে নতুন সমিতি গঠন করা হবে। দেখা হবে বাজারে রাতে যেন কোনও অবাঞ্ছিত লোক না থাকে।” তিনি আরও জানান, বাজারের প্রধান দরজা রাতেও খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
|
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
|
|
|
|
|