স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একের পর এক চুরি হওয়ায় থানায় পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক। উল্টে তাঁরই জামার কলার ধরে টানা-হ্যাঁচড়া ও কটূক্তির অভিযোগ উঠল বিনা-উর্দিতে থাকা এক সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে।
বুধবার দুপুরে ওই ঘটনার পরেই এসডিপিও-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানান কাটোয়া-২ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক (বিএমওএইচ) চন্দ্রশেখর মাইতি। পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে জেলাশাসক পর্যন্ত সকলকে চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরস্থান, রাত পর্যন্ত বিষয়টি ‘মিটিয়ে ফেলার’ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে পুলিশ।
অভিযুক্ত এসআই সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় স্বাস্থ্যকর্তার কলার ধরার কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, চিকিৎসকেরা পুলিশের সমালোচনা করায় তিনি ‘প্রতিবাদ’ করেছেন মাত্র। কিন্তু গোটা ঘটনায় যে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে তা হল, বিএমওএইচ স্তরের সরকারি অফিসার যদি থানায় গিয়ে নিগৃহীত হন, সাধারণ মানুষ পুলিশের উপরে ভরসা রাখবে কী করে? |
কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “এই ঘটনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই মনে হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?” সিপিএমের কাটোয়া জোনাল কমিটির সম্পাদক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “গোটা রাজ্যে পুলিশি-রাজ চলছে। এটা তারই দৃষ্টান্ত।” শাসকদল তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথও বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তাঁর মতে, “এই ধরনের ঘটনা বাঞ্ছনীয় নয়। তদন্ত হওয়া দরকার।” জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। যা ঘটেছে, সেটা ঘটা উচিত হয়নি।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০০৯ সালে চন্দ্রশেখরবাবুর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ডাকাতি করে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কর্মীরা কতটা ভয় পেয়ে যান, তা তাঁর ভাল মতোই জানা আছে। গত ২০ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে দাঁইহাটের কাছে নওয়াপাড়ায় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরপর চুরি হয়। চিকিৎসক ও কর্মীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় বিএমওএইচ পুলিশকে জানান। এ বিষয়ে আলোচনার জন্যই এ দিন তাঁদের কাটোয়া থানায় ডাকা হয়েছিল।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক সৌরভ মাইতি, নার্স শ্যামলী পাত্র ও তাপসী মণ্ডল, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী অতনু ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরে থানায় যান চন্দ্রশেখরবাবু। তাঁর অভিযোগ, “মেজোবাবুকে আমাদের সমস্যার কথা বলছিলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের চিকিৎসক ও কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। হঠাৎই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘যা বলার আমাকে বলুন’। উনি যে থানার এসআই সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, তা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওঁকে কিছু বলতে রাজি না হওয়ায় উনি আমার হাত ধরে, জামার কলার ধরে টানতে থাকেন।”
চুরির অভিযোগে ধৃতদের সামনেই এসআই এই আচরণ করেন বলেও অভিযোগ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। প্রত্যক্ষদর্শী চিকিৎসক সৌরভ মাইতির অভিযোগ, “একের পর এক চুরি হচ্ছে বলে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ ওই এসআই আমাদের পেশা নিয়ে বাজে কথা বলতে শুরু করেন। চন্দ্রশেখরবাবুর জামার কলার ধরে টানতে থাকেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে যদি পুলিশ এ রকম ব্যবহার করে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী হয়, বোঝাই যাচ্ছে!” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দিলীপ মণ্ডল বলেন, “খবর পাওয়া মাত্র বিএমওএইচ-কে অভিযোগ দায়ের করার নির্দেশ দিই। আমিও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।” এসডিপিও (কাটোয়া) ধ্রুব দাসের কাছে লিখিত অভিযোগের প্রতিলিপি ফ্যাক্স মারফত পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের কাছে যাওয়ার পরেই সব পক্ষ নড়েচড়ে বসে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদারের দফতরে চন্দ্রশেখরবাবুদের নিয়ে বৈঠক করা হয়। দীর্ঘ কথাবার্তার পরে পুলিশ সূত্রে দাবি করা হয়, ‘ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে।’ যদিও পুলিশকর্তাদের কেউ প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। রাতে চন্দ্রশেখরবাবু বলেন, “আমি অভিযোগ ফিরিয়ে নিচ্ছি না। আইন আইনের পথে চলবে।” |