সাক্ষাৎকার ...
জমির ব্যাপারে সরকারকে থাকতেই হয়


এটা ঠিকই যে জমির দাম একটা সীমার বেশি হয়ে গেলে শিল্পস্থাপন আর সম্ভব হবে না। আবার সরকার কম দামে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প তৈরি করবে, সেটাও কাম্য নয়। তা ছাড়া, আগেই বলেছি যে জমির মূল্য এক এক জন কৃষকের কাছে এক এক রকম। ফলে ক্ষতিপূরণের যথাযথ অঙ্ক নির্ধারণ করা কঠিন। তবে মধ্যপন্থা যে নেই, তা নয়। আমি এবং দিল্লি স্কুল অব ইকনমিকস-এর অধ্যাপক পরীক্ষিৎ ঘোষ একটা বিকল্প মডেলের কথা বলেছিলাম নিলামের মাধ্যমে জমির দাম স্থির করা। বিভিন্ন পঞ্চায়েত শিল্পের জন্য জমি দেওয়ার প্রস্তাব করবে, এবং একটি ন্যূনতম দাম স্থির করে দেবে। এ বার শিল্পমহল তাদের সামনে থাকা সবক’টি প্রস্তাব থেকে সবচেয়ে পছন্দসই জায়গা বেছে নেবে এবং যে শিল্পগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি দাম দিতে রাজি হবে, তারাই জমি পাবে। এতে পুরো প্রক্রিয়াটা উল্টে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ রতন টাটা একটা জমি বেছে নিলেন এবং তার পর ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক হাজার ঝামেলা আরম্ভ হল এই পথে না গিয়ে যারা ইচ্ছুক (সেই কারণেই জমি বেচার প্রস্তাব পাঠাবে পঞ্চায়েত), তাদের মধ্যে থেকে জমি বেছে নেওয়া হল। এতে এক দফা ঝামেলা কমবে।
এর পর বেছে নেওয়া পঞ্চায়েতটি প্রত্যেক জমির মালিককে তার মনোমত দর দিতে বলবে। ধরা যাক, শিল্পের জন্য হাজার একর জমি চাই। গ্রামে দু’হাজার মানুষের মাথাপিছু এক একর করে মোট দু’হাজার একর জমি রয়েছে। দু’হাজার জনই দর জমা দেবেন। সেই দরকে যদি কম থেকে বেশি, এ ভাবে সাজানো হয়, তবে প্রথম এক হাজার জনের জমি কেনা হবে। অর্থাৎ সবচেয়ে কম দামে যে এক হাজার একর জমি পাওয়া যাবে, সেটাই কিনে নেবে পঞ্চায়েত। এই এক হাজার জনের চেয়ে যাঁরা বেশি দর দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁর দর সবচেয়ে কম, অর্থাৎ তালিকায় যিনি ১০০১তম, তিনি যে দরে জমি বেচতে চেয়েছিলেন, সেই দর দেওয়া হবে আগের ১০০০ জনকে। মানে, যত লোকের জমি কেনা হল, তাঁদের প্রত্যেকে যে দাম চেয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি দাম পেলেন।
‘... সূচ্যগ্র মেদিনী।’ সিঙ্গুর, ২০০৬। ছবি: অমিত দত্ত
কিন্তু যে হাজার জন জমি বেচলেন, তাঁদের জমি যে পাশাপাশিই হবে, তেমন তো নয়। মাঝখানে ‘অনিচ্ছুক’ চাষির জমিও থাকতে পারে। এ বার শিল্পের জন্য যে এক হাজার একর প্রয়োজন, তাকে চিহ্নিত করে দেওয়া হল। সেই সীমানার মধ্যে কিছু জমি ইতিমধ্যেই কিনে নেওয়া হয়েছে, কিছু জমি হয়নি। আবার, সীমানার বাইরে যত জমি পড়ে থাকল, তারও কিছুটা কেনা, কিছুটা নয়। এ বার, সীমানার মধ্যে যে অনিচ্ছুকরা আছেন, তাঁদের সীমানার বাইরে অধিগৃহীত জমিতে পুনর্বাসন দেওয়া হল। যেহেতু একই গ্রামের, একই চরিত্রের জমি, তাঁদের আপত্তির কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকবে না। এই পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি শেষ হলেই সীমানার মধ্যে সব জমি ফাঁকা সেখানে শিল্প হবে। সীমানার বাইরে অনিচ্ছুকরা নিজেদের জমি নিয়ে থাকবেন। আর যাঁরা জমি বেচে দিয়েছেন, তাঁরা তো নিজেদের পছন্দের চেয়ে বেশি দরই পেলেন। এই পদ্ধতিতে অশান্তি ছাড়াই শিল্পের জমি পাওয়া সম্ভব হবে।



এই কথাটার সঙ্গে একেবারেই একমত নই। হ্যাঁ, পুলিশ আর ক্যাডার নিয়ে গিয়ে গায়ের জোরে জমি কেড়ে নেওয়াটা অন্যায়। সেটা কখনও না করা ভাল। কিন্তু সেটাই তো সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য ভূমিকা নয়। বস্তুত, সরকারের মূল দায়িত্ব হল যাতে বাজারে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক লেনদেন হতে পারে, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মানুষ যাতে জমির ওপর ক্রমশ কম নির্ভর করে ভাল ভাবে বাঁচতে পারেন, তার বন্দোবস্ত করা। ধরা যাক, কোনও এক চাষি জমি বিক্রি করে হাতে টাকা পেলেন। তিনি সেই টাকা কোথায় রাখবেন? গ্রামে ব্যাঙ্কের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে, এটিএম বানাতে হবে। এগুলোর পরিকাঠামো সরকারকেই তৈরি করে দিতে হবে। ভারত যদি হংকং হত, তা হলে সরকার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারত, সেখানে প্রায় সব কাজই বেসরকারি সংস্থা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমানবন্দর তৈরির মতো প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে, শিল্পের জন্য জমি সংশ্লিষ্ট সংস্থাই কিনে নেয়। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে সে দেশে জমির বাজার ঠিকঠাক কাজ করে বলে। আমাদের এখানে সরকার কোনও মতেই নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি ছাড়া জমিজমার ক্ষেত্রে কোনও লেনদেন কি সম্ভব? হাজার সরকারি নিয়ম আছে জমি বা বাড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে (যেমন চাষের জমির ক্ষেত্রে বর্গা আইন)। তাই বাজারে কেনাবেচা হলেও, সরকার বা প্রশাসনের কোনও ভূমিকা থাকবে না, এটা বলা যায় না। আর শিল্পের ক্ষেত্রে সমস্যা তো শুধু জমির পরিমাণ নিয়ে নয়, পরিবহণ-বিদ্যুৎ ইত্যাদি পরিকাঠামো বিষয়ে সরকারের ভূমিকা আছে। তাই সরকারের কোনও ভূমিকা থাকবে না, এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া, জমির মাফিয়াদের কবল থেকে ক্ষুদ্র কৃষিজীবীদের বাঁচাতে এবং বড় সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সরকার যদি কৃষকের পক্ষে থাকে, সেটা মানুষের জন্য খুব জরুরি। জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে, বা জমি বিক্রির পর হাতের টাকা রাখার ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি, সেগুলো ঠিক ভাবে রাখার, চালানোর দায়িত্ব সরকারের। বাজারকে সাহায্য করার, বাজারের পরিসর বাড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। সে দায়িত্ব না নিলে সাধারণ মানুষই সমস্যায় পড়বেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.