অসহিষ্ণুতা আমাদের রাজ্যে পুরনো এবং পরিচিত ব্যাধি। যখনই কেউ বেচাল কথাবার্তা
বলেছেন বা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অস্বস্তিকর কোনও কাজ করেছেন, বরাবর
এবং বার বার তাঁদের দমনের ব্যবস্থা হয়েছে। লিখছেন
অশোককুমার মুখোপাধ্যায় |
সুমন মুখোপাধ্যায়ের একটি চলচ্চিত্রের তিন-চারটি অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর আঞ্চলিক বিভাগ ছাড়পত্র আটকাতে চাইছে। অনেকেরই মনে হচ্ছে, এ কাজ ‘গণতন্ত্রবিরোধী’। কেন মনে হয়েছে? একটি দৃষ্টান্ত। ওই ছবিতে দেখা গেছে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান এক জন বিতৃষ্ণার চোখে দেখছেন। এটাই নাকি বোর্ডের আপত্তির অন্যতম কারণ। প্রতিবাদীদের যুক্তি, এ আপত্তি অগণতান্ত্রিক; কেউ যদি ‘পরিবর্তন’-এ উল্লসিত না হয়, সেটা তার অধিকার, তা দেখানো যাবে না কেন?
ঠিক কথা। এমন একটা গণতান্ত্রিক, খোলামেলা যুক্তির পরিসর থাকলে সত্যিই বড় ভাল হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই পরিসরটা এ দেশে প্রায় সর্বত্রই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। দৃষ্টান্ত চাইলে বলব, দয়া করে জয়পুরে আশিস নন্দীর ঘটনাটা এক বার ঝালিয়ে নিন। কিংবা মনে করুন সলমন রুশদির কলকাতায় (না) আসার কাহিনি।
অন্য রাজ্যের কথা থাক। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে অসহিষ্ণুতার নানা নজির নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অভিযোগের তর্জনী উঠেছে শাসকদের দিকে। সেটা অস্বাভাবিক নয়, অন্যায়ও নয়। কিন্তু একই সঙ্গে একটা কথা খেয়াল করা দরকার। অসহিষ্ণুতা আমাদের রাজ্যে পুরনো এবং পরিচিত ব্যাধি। যখনই কেউ বেচাল কথাবার্তা বলেছেন বা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অস্বস্তিকর কোনও কাজ করেছেন, বরাবর এবং বার বার তাঁদের দমনের ব্যবস্থা হয়েছে। কখনও প্রিভেনটিভ ডিটেনশন আইন কাজে লাগিয়ে, কখনও ভারত রক্ষা আইন বা ডি আই আর, কখনও বা এসমা কিংবা মিসা। কখনও আবার নিজ দলের বিদ্বজ্জনকে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করায় উৎসাহিত করে সমস্ত বিরুদ্ধতা সবলে উপড়ে ফেলবার চেষ্টা চলেছে। |
অর্ধ শতাব্দী পিছিয়ে যাওয়া যাক। বাষট্টিতে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় প্রবল এবং অনিয়ন্ত্রিত উৎসাহে পীত-জাতিদ্বেষের আবহাওয়া তৈরি করা হচ্ছে, সেই উন্মাদনার বিরুদ্ধে যুক্তির কথা বললেই ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার। কার্টুন এঁকে দেখানো হচ্ছে: চিনারা শূকরের মতো বংশবৃদ্ধি করে। এই অশালীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই আপনি চিহ্নিত হবেন দেশদ্রোহী বলে। দুয়ো দেবে সতীর্থরা। নিমেষে চেনা মুখ অচেনা হয়ে যাবে।
আবার, ষাটের দশকের মধ্যভাগে উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকের বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করে দিয়েছিল অনেক সংবাদমাধ্যম। অধিকাংশই না-হয় ‘বুর্জোয়া সংবাদপত্র’। কিন্তু সি পি এমের মুখপত্র দেশহিতৈষী-ও এদের সঙ্গে জুটল কেন? না, উৎপল নকশালবাড়ির সমর্থনে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, নকশালদের সঙ্গ করছেন। আবার, নকশালদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হওয়ার পর তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’ উৎপলের ‘মানুষের অধিকারে’ প্রযোজনাটিকে আক্রমণ করে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক একটি নিবন্ধ ছাপল ‘দেশব্রতী’তে। ওই, গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু উৎপল তথা তাঁর দল এল টি জি যখন এর উত্তর দিল, ছাপা হল না দেশব্রতী-তে। গণতন্ত্র?
অথবা সেই দিনের ঘটনাও মনে করা যাক। ২৬ অগস্ট ১৯৭৪। ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ প্রযোজনার জন্য স্টার থিয়েটারে উৎপল দত্ত, তাপস সেন-সহ তাঁদের দলের অন্যান্যরা শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ‘দেশ’ পত্রিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (সনাতন পাঠক) লিখেছিলেন, ‘এ কি ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণ? তাই যদি হয়, তা হলে আর গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে লাভ কী?’
এই ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকারটি আসলে কেমন, বলে দিয়েছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কাছে গিয়েছিল প্রতিবাদী বিদ্বজ্জনদের প্রতিনিধি দল। মুখ্যমন্ত্রী তাদের বলেছিলেন, ‘মঞ্চকে তোমরা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত করলে জনতার একাংশের অভ্যুত্থান হতে পারে সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে।’
এর পরে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারও মোটামুটি এই বচন মেনেই সংস্কৃতি শাসন করে গিয়েছে। কেউ পছন্দের না হলেই তাকে জায়গা দেওয়া হয়নি। কণ্ঠ স্তব্ধ করা হয়েছে। কোনও বামমার্গী বুদ্ধিমানের সাহায্যে চালানো হয়েছে পরোক্ষ উৎপীড়ন। সে সব কাহিনি বহুচর্চিত। যুক্তিবাদীরা রবীন্দ্রনাথের বলা কথার মধ্যে সে দিনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, ‘আমি যখন প্রশ্ন করতে যাই, বিচার করতে যাই, আমার হিতৈষীরা ব্যাকুল হয়ে আমার মুখ চাপা দিয়ে বলেন, আজ তুমি কিছু বোলো না। দেশের হাওয়ায় আজ প্রবল একটা উৎপীড়ন আছে সে লাঠি-সড়কির উৎপীড়ন নয়, তার চেয়ে ভয়ংকর সে অলক্ষ্য উৎপীড়ন... কেবল বাধ্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। কার কাছে বাধ্যতা। মন্ত্রের কাছে, অন্ধবিশ্বাসের কাছে।’ (সত্যের আহ্বান, কালান্তর)।
সেই ধারা পালটায়নি, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের শাসনক্ষমতায় এসে এমন মান্যতা উৎপাদনের ধারাই বজায় রাখছে। তবে, তাদের ব্যবস্থাটি, আশিস নন্দীকে ধার করে বলতে হয়, পূর্বতনদের মতো মসৃণ নয়, সে জন্যই সতত নজর কাড়ে।
অথচ, সুষ্ঠু শাসনের স্বার্থে, সমাজের বাঁধন দৃঢ় রাখার স্বার্থেই ভিন্ন সুর শোনা অতীব প্রয়োজন। তা ছাড়া, তাতে সমস্যাই বা কী? নিজেদের কার্যক্রমের যুক্তিতে যদি সত্য থাকে, বিজ্ঞান থাকে, তা হলে বিরুদ্ধ যুক্তি শুনতে আপত্তি কেন? যুক্তিতে যদি ধার থাকে, তবে তাকে আতুপুতু করে রাখতে হবে কেন? ভ্রান্ত যুক্তিকে পরাজিত করে ঠিক পন্থা জয়ী হবেই। আর, যদি ভুল থাকে কোথাও, সে ভুল সংশোধন করে নিলে তো শাসকের বা তাঁর অনুগামীদের ভাবমূর্তি একটুও ম্লান হয় না, বরং উজ্জ্বল হয়।
ভিন্ন সুর কান পেতে শুনলে, তা প্রকাশিত হতে দিলে দেশের ও দশের মঙ্গল। এমন বুঝেই মাও জে দং বলেছেন, কমিউনিস্টদের সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, কারণ সত্য জনতার স্বার্থ দেখে। ১৯৫৮, ২২ মার্চ চেংডু সম্মেলনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বলেন, ‘যা বলার আছে মুক্তকণ্ঠে বল। সুবিধাবাদী বলে চিহ্নিত হতে, কাজ থেকে ছাঁটাই হতে, পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে, স্ত্রী কর্তৃক পরিত্যক্ত হতে (ও জনসাধারণের নিন্দাভাজন হতে), রাষ্ট্র দ্বারা নির্যাতিত হতে বা ফাঁসির কাঠে ঝুলতে ভয় পেয়ো না। কোনও কিছুকেই ভয় কোরো না।’ পরের বছর লুসান সম্মেলনে এই কথারই পুনরাবৃত্তি ‘যা বলার আছে বলো। আমার মধ্যে যদি দোষ দেখ, তা হলে আমাকে সংশোধন করো। নির্ভীক হও।’ মত প্রকাশের এই গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরি করে দেওয়ার ফলে মাও জে দঙের গরিমা কমেনি, বেড়েছে।
কিন্তু আমাদের রাজ্যের তথা দেশের শাসকরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কাজে উল্টোটা করে থাকেন। এবং, ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে রাজ্যের তথা দেশের অন্য অনেক শাসকের মতোই তৃণমূলও চেয়েছে নিজেদের ‘পণ্ডিত’, যারা তার হয়ে স্তোত্র রচনা করবে। ক্ষমতায় এসে এখন তারাও চাইছে প্রশ্নহীন আনুগত্য, সেই চাহিদা না মিটলেই শাসকের অসহিষ্ণুতা প্রকট হচ্ছে, বস্তুত বাড়ছে।
ক্ষমতা এ-রকমই। সে চায় নিজেকে নিরঙ্কুশ করতে। আর সেখানেই গণতান্ত্রিকতার লড়াই। গণতান্ত্রিক পরিসরটি কোনও নাড়ু নয় যে হাত ঘোরালেই শাসক টুপ করে তা হাতে দিয়ে দেবে। স্বেদ-তিতিক্ষার বিনিময়ে গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরি করবার আন্দোলনটি শুরু করতে হবে সৎ সাহসী বিদ্বজ্জনদের। আশিস নন্দীর বক্তব্য পছন্দ না হলে তাঁর যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি শানাও, সলমন রুশদির কথাবার্তার চালাকি ভাল না লাগলে তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষের ভাষা তুমিও আয়ত্ত করো, সুমনের ছবির বিদ্রুপের ভঙ্গি ভাল না লাগলে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তি দাঁড় করাও। স্তালিনের প্রতি আক্রমণের যুক্তি পছন্দ না হয়, অসুবিধে কোথায়? তাকে প্রকাশিত হতে দেওয়া হোক। (স্তালিন বেচারি তো এখন রাম-শ্যাম-যদু যে কোনও লোকের ঢিলের লক্ষ্য!) স্তালিনের পক্ষে দাঁড়িয়ে হাজার একটা কথা বলাই যায়। সে যুক্তি তুলে ধরো তুমিও। তুমুল তর্ক চলুক, কিন্তু গায়ের জোরে অধিকার আদায়ের চেষ্টা কেন?
গোলমালটা এখানেই। বিদ্বজ্জনদের উচিত ছিল স্বধর্মে সুস্থিত থেকে সমবেত ভাবে সরকারকে চাপ দেওয়া, যাতে তারা গণতান্ত্রিক পরিসরটিকে নষ্ট করতে না পারে। তার বদলে তাঁরা পরস্পরকে বুদ্ধিহীন আক্রমণ করে চলেছেন। এ রাজ্যের যে বিদ্বজ্জনেরা বাম জমানার অবসান ঘটাতে তৎপর হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আজ নির্ভেজাল অন্যায়ের সামনে মৌন অবলম্বন করেছেন। অনতিঅতীতে যেমন মৌনী ছিলেন পরে-সরব-হয়ে-ওঠা কিছু বিদ্বজ্জন। তাঁরা তখন বাম জমানার অন্যায় দেখলেও জিভ কেটে পালাবার চেষ্টা করতেন, রা কাড়তেন না। এক জনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আপনাদের মন্ত্রী এমন উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলছেন বা এ রকম অশালীন ভঙ্গি করছেন, এর প্রতিবাদ করছেন না কেন? তিনি বললেন, তার আগে দেখতে হবে, আমার প্রতিবাদ কার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করছে! ক্ষমতাসীনদের আড়াল করার চেষ্টায় মাননীয় বুদ্ধিমানেরা যে-সব কথা সে দিন বলেছেন, তারই পুনরাবৃত্তি করছেন আজকের বুদ্ধিমানেরা।
এ এক ধরনের আত্মরতি। নিজের অধীত জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাও। এর ফলেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ক্রমশ দূরে সরে যায় গণতান্ত্রিক পরিসর গড়ার স্বপ্ন। |