দোষ চাপানোর খেলাতেই পার পেয়ে যায় অবৈধরা |
নটেগাছটি মুড়োনোর গল্পের মতোই এ যেন দোষ চাপানোর এক অন্তহীন চক্র। কারণ দায় যারই হোক, এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই দোষ চাপাচ্ছে আগের আমলের উপরে।
আদতে যে বাড়ি পুরসভার খাতায়-কলমে ‘প্রাইভেট প্রেমিসেস’ বা আবাসিক এলাকা বলে চিহ্নিত, সেখানেই ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই রমরম করে চলছিল ১৩৬টি দোকান। শিয়ালদহের বাজারে আগুন লাগার পরে এমনটাই জানিয়েছে পুরসভার কর মূল্যায়ন দফতর। এমনটা হল কী করে? দমকলমন্ত্রী যখন দায় চাপাচ্ছেন পূর্বতন পুর-বোর্ডের উপরে, প্রাক্তন মেয়রের আঙুল উঠেছে তাঁর পূর্বসূরির দিকে।
রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খান বলছেন, “চট্ করে সব ব্যবস্থা আমরা বদলাতে পারব না। জানি অনেক বসতবাড়িতে আগের আমল থেকে ব্যবসা চলছে। তা বেআইনিও। এ বার থেকে নজরদারি চালু করতে হবে।” তবে ওই দায় গত পুর-বোর্ডের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন জাভেদ।
জবাবে গত বাম পুর-বোর্ডের মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আবার তাঁর পূর্বসুরি সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দায়ী করেছেন। বিকাশবাবুর কথায়, “ওঁর আমলে বেশি করে রাজস্ব আদায়ের নামে দেদার ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।” বিকাশবাবু বলেন, “আমি বা যে-কেউ মেয়র পদে থাকি না কেন, পুর অফিসারেরা এটা ঠিক কাজ করেননি।”
অভিযোগ মানতে নারাজ প্রাক্তন মেয়র তথা বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমি শুধু কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দালালরাজ রুখতে একটা প্রক্রিয়া চালু করেছিলাম। দালালের মাধ্যমে কর দেওয়া বন্ধ করা হয়েছিল। সরাসরি ডিমান্ড নোটিস পাঠানো হত দোকানদারের কাছে।”
প্রশ্ন উঠেছে, শিয়ালদহের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বছরের পর বছর ধরে একটি আবাসিক বাড়িতে এত বড় ‘বেআইনি’ কারবার চলল কী ভাবে? তপসিয়া বা তিলজলা বা গার্ডেনরিচের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় আগুন লাগলে সরু রাস্তা, গাড়ি ঢোকে না ইত্যাদি যে ধরনের যুক্তি দেওয়া হয়, কলকাতার প্রাণকেন্দ্র শিয়ালদহে বড় রাস্তার উপরে এমন ঘটনায় কি সেই যুক্তি ধোপে টেকে?
ঘটনার পরে তৃণমূল দোষ চাপাতে চেয়েছে বিগত বাম পুর-বোর্ডের উপরে। কিন্তু পুরসভার রেকর্ডই বলছে, বাম এবং তৃণমূল দুই বোর্ডের কেউই এ সব নিয়ে মাথা ঘামাননি। ওই রেকর্ড অনুসারে, ১৯৮৫-৮৬ সালে ৩৪/১এ, ৩৪/১বি এবং ৪৬/১ সূর্য সেন স্ট্রিটের তিনটি প্রেমিসেস এক করা হয়। যেহেতু এপিসি রোডের উপরে এই বাড়ির সামনের একটি অংশ রয়েছে, তাই এটির ঠিকানা ৩৫ এপিসি রোড হিসেবেও চিহ্নিত। ১৯৮৫-৮৬ সালে বাড়িটি চারতলা ছিল। কর মূল্যায়ন দফতরের এক পদস্থ অফিসার জানান, বাড়িটির মালিক হলেন নরেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ ও শৈলেন্দ্রনাথ সাহা। পরে বাড়িটি ৬ তলা হয়। তবে বর্ধিত তলগুলি বৈধ কি না, তা বলতে পারেননি ওই অফিসার।
এ দিকে, পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের হিসেবে বাড়িটি পাঁচতলা। বিল্ডিং বিভাগ আরও জানিয়েছে, ওই বাড়িতে একটি বেসমেন্ট রয়েছে। যদিও কর মূল্যায়ন দফতরের মতে, বেসমেন্ট নেই।
ওই বাড়িতে অগ্নি-নির্বাপণের ব্যবস্থা নেই কেন? তারও একটা জবাব দিয়েছে পুরসভার কর মূল্যায়ন দফতর। তাঁদের কথায়, ওটি প্রাইভেট প্রেমিসেস। যেহেতু রেকর্ডে মার্কেট নয়, তাই অগ্নি-নির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলকও নয়। কিন্তু এক সঙ্গে এতগুলো দোকান আবাসিক চত্বরে কী ভাবে চলছিল সে সবের কোনও জবাব ওই কর্তারা দিতে চাননি।
বিল্ডিং দফতরের মতে, বাড়িটির একতলায় বাজার ছিল। আর উপরের তলগুলি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হত। সে ক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকা জরুরি ছিল। তা না-থাকায় অভিযোগ উঠছে পুর-প্রশাসনের বিরুদ্ধেই। অন্তত কর আদায়ের সময়ে বিষয়টি কারও নজরে এল না কেন, সে প্রশ্ন করেছেন পুরকর্তারা।
এ দিকে, এই অগ্নিকাণ্ডের পরে পুর-কমিশনারের নির্দেশে শহরের প্রতিটি বেসরকারি বাজারে ঘুরবে পুরসভা ও পুলিশ। মেয়র পারিষদ (মার্কেট) তারক সিংহ জানান, এ ধরনের মার্কেটের তালিকা করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। |