|
|
|
|
|
যত আগুন তত কমিটি,
কাজের কাজ হয় কি
ঋজু বসু ও শমীক ঘোষ |
|
ফের একটি আগুন। ফের একটি কমিটি। এবং ফের হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা। এ বারও সেই নিয়মের অন্যথা হল না।
গত দু’দশকে বার বার এই এক ছবি দেখা গিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে কতটুকু? হলে, কেন বার বার একই ভাবে অঘটন ঘটে চলে এ শহরে? সূর্য সেন স্ট্রিট বাজারের আগুনের পটভূমি ফের এই সব পুরনো প্রশ্নই খুঁচিয়ে তুলল।
বিপদ এড়ানোর রাস্তা খুঁজতে বুধবারও যথারীতি নতুন কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম-আমলে নন্দরাম মার্কেট বা স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ড কিংবা রাজ্যে পালাবদলের পরে আমরি হাসপাতালের ঘটনার পরে যেমনটি দেখা গিয়েছিল। তবে এ বারের কমিটিতে কিছুটা অভিনবত্বও থাকছে! একটি নয়, দু’টি কমিটি। স্রেফ দমকল, পুলিশ, পুরসভার কর্তাদের নিয়ে বাঁধা-ধরা তদন্ত কমিটি নয়। আর একটিতে থাকবেন শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরাও।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি পুলিশ কমিশনার, মেয়র, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রীকে নিয়ে তদন্ত কমিটি যেমন গড়ব, তেমনই ভাবছি শহরের নাগরিকদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ব।” আগুনের আঁচ নিভতে না-নিভতেই ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এ কথা শুনিয়ে দিয়েছেন মমতা। তদন্ত কমিটি তিন দিনের মধ্যে কারণ খুঁজে বার করে রিপোর্ট দেবে বলে এ দিন আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পরিকল্পনাহীন এই শহরে কী ভাবে এই ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় নাগরিকদের কমিটিকে তার উপায় বের করতে বলব।” |
|
কিন্তু এ রাজ্যের কমিটি-পরম্পরার যা ইতিহাস, তাতে খুব বেশি লোকে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। তা ছাড়া, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেলের নিরাপত্তা থেকে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, পরিচ্ছন্নতার দিকগুলি ঢেলে সাজতেও এমন বেশ কয়েকটি কমিটি তৈরি করেছিলেন মমতা। বাংলার নাট্যকর্মী, কবি, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, শিক্ষক প্রমুখ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনেদের মাসে মাসে মোটা টাকা সাম্মানিক দিয়ে সেই কমিটি বহালও থাকে দীর্ঘ দিন। কিন্তু নানা বিষয়ে কমিটিগুলি বিস্তর সুপারিশ করলেও তাতে কাজের কাজ কী হয়েছে, তার সদুত্তর মেলেনি। পরে মমতা রেলমন্ত্রক ছাড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ওই কমিটিগুলির কার্যত পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। ফলে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গেই কলকাতার জন্য নতুন কমিটির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
গত দু’দশকে বড়-সড় অঘটনের পরে সরকারি কমিটিগুলির ভূমিকাও তথৈবচ। প্রতি ক্ষেত্রে কমিটির তরফে নিরাপত্তার কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশ মানা হল কি হল না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা আর দেখা হয়ে ওঠে না। ’৯০-এর দশকে ফেয়ারলি প্লেসের ম্যাকিনন অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জি ভবনই হোক বা বছর দশেক আগের ফারপো-কাণ্ড এটাই হয়ে এসেছে। ম্যাকেঞ্জি ভবন ভেঙে এখন শপিংমল তৈরি হচ্ছে। নন্দরাম বা স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি ছাড়াও পরিদর্শক কমিটি গড়ে ওঠে। দমকলের সঙ্গে পুলিশ, পুরসভা, সিইএসসি, পূর্ত দফতর, সিইএসসি-কে সামিল করে শহরের ‘জতুগৃহ’গুলির দিকে নজর ফেরায় প্রশাসন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ সামান্যই ঘটেছে।
২০১১-র ডিসেম্বরে আমরি-কাণ্ডের পরে দেখা যায়, স্রেফ সাবেক কলকাতার পুরনো পাড়াগুলিই নয় সাম্প্রতিক অতীতের ঝকঝকে বহুতলগুলিও মোটেও নিরাপদ নয়। বর্তমান সরকারের আমলেই তখন গড়ে ওঠে এক গুচ্ছ কমিটি।
• যেমন, শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোমের অবস্থা খতিয়ে দেখতে দমকলের প্রাক্তন ও বর্তমান কর্তা এবং অগ্নি-কাণ্ড বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গড়া হয় ফায়ার সেফটি অডিট কমিটি।
• কলকাতা তথা বিভিন্ন শহরে বিল্ডিং আইন ঢেলে সাজতে এক প্রাক্তন পুরকর্তার অধীনে গড়ে ওঠে কমিটি।
• পুরসভার বিভিন্ন বরো এলাকায় অগ্নি-প্রবণ বাড়ি-সংক্রান্ত কমিটি এবং দমকলের ছাড়পত্র দেওয়ার পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি কমিটিও মাথা চাড়া দিয়েছে।
এতগুলি কমিটির কোনওটিই এখনও পর্যন্ত কাজ শেষ করে উঠতে পারেনি। ফলে কমিটির সদস্যদেরই হতাশা গ্রাস করছে।
কেন এই অবস্থা? নন্দরাম বা স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে গড়ে ওঠা পরিদর্শক কমিটির সদস্য এক আধিকারিক বলছেন, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কমিটি বড় জোর বার বার সুপারিশ করতে পারে, কিন্তু সেই সুপারিশ অগ্রাহ্য করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে কে?” স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডের পরে গোড়ায় শহরের কয়েকটি বাজারের কর্তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করে পরে পিছিয়ে আসে তৎকালীন প্রশাসন। দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের অবশ্য দাবি, তাঁরা ক্ষমতায় এসে নিরাপত্তা-বিধি না-মানায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছেন। কিন্তু পুলিশের নথিতে সেই হিসেব মিলছে না।
ফলে, সূর্য সেন স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে মমতা এ বার কড়া হওয়ার কথা বললেও, বাস্তবে তিনি কত দূর এগোতে পারবেন তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। মমতাই এ দিন মেনে নিয়েছেন, “আমরির ঘটনার পরে হাসপাতাল, বাজার সবাইকে বলা হয় আপনারা সুরক্ষা বিধি যথাযথ প্রয়োগ করুন। কিন্তু অনেক জায়গাতেই তা করা হয়নি। কলকাতা শহরে এরকম বহু জায়গা আছে।” দমকলমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “আমরা প্রথমে হাসপাতাল, পরে বাজার ধরে ধরে দফায় দফায় কাজ করছি। ৪৭টি বাজারকে নোটিসও ধরিয়েছে। দেড় বছরে সব কাজ তো করা যায় না!” |
আগুনের গ্রাস |
• ৯ জুন, ১৯৮৭ ক্যানিং স্ট্রিটের ভগবানদাস কাটরায়। মৃত ৭
• ৮ মার্চ, ১৯৮৯ এপিসি রোডের নন্দবাগানের বস্তিতে আগুন। মৃত ৫।
• ৫ জানুয়ারি ১৯৯২ বড়বাজারের লক্ষ্মী কাটরায় আগুন।
• ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ কলকাতা বইমেলায় আগুন।
• ২৩ এপ্রিল, ২০০২ ধর্মতলার ফিরপো মার্কেট। দু’দিন পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে।
• ২০ ডিসেম্বর,২০০২ মহাত্মা গাঁধী রোডে পুরনো বাড়িতে। তিন দিন পরে আগুন আয়ত্তে।
• ২২ এপ্রিল,২০০৩ বড়বাজারে সত্যনারায়ণ পার্কের ভূগর্ভস্থ বাজারে। ৩৫০ দোকান ছাই।
• ২২ নভেম্বর,২০০৬ তপসিয়াতে চামড়ার ব্যাগ তৈরির কারখানায়। মৃত ১০।
• ১২ জানুয়ারি,২০০৮ বড়বাজারের নন্দরাম মার্কেটে। উপরের চারটি তলা ভস্মীভূত।
• ২৩ মার্চ,২০১০ পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টে। মৃত ৪৩।
• ০৯ ডিসেম্বর,২০১১ ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে। মৃত ৯৩। |
|
নিরাপত্তার কথা ভেবেই মহাকরণের পিছনের ক্যান্টিন তিনি তুলে দিয়েছিলেন বলে এ দিন দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর দলের সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনের তরফেই মহাকরণ ও লাগোয়া সরকারি অফিসগুলির জতুগৃহের দশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পুড়ে যাওয়া বাজারটিতে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য শহরের ব্যবসায়ী বা দোকান-মালিকদের উদ্দেশে নরমে-গরমে তাঁর বার্তা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “দেড় বছর ধরে বলে আসছি। এ বার কিন্তু আমরা কড়া হব।” সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলছি না। লাইসেন্স বাতিলের কথা বলছি না। কিন্তু সবাইকে তো সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে।”
এই সুরক্ষার ব্যাপারে কলকাতাকে সচেতন করা যে কতটা কঠিন, তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রশাসনিক কমিটির সদস্যেরাই। স্টিফেন কোর্ট-পরবর্তী পরিদর্শক কমিটির সদস্য এক পুলিশ অফিসারের কথায়, “গত শনিবারও আমরা ওল্ড চায়নাবাজার স্ট্রিটে বোথরা মার্কেটে গিয়েছি। ৫ বছর ধরে বলার পরে তারা সবে কাজ শুরু করেছে।” আমরি-কাণ্ডের পরে আরও বেশ কিছু বহুতল, হোটেল, ক্লাব, শপিংমলকে ওই কমিটির আওতায় আনা হয়। তারা এখনও সাপ্তাহিক রুটিন মেনে পরিদর্শন ও মিটিং করে চলেছে। কেউ কেউ সুরক্ষা-বিধি মানলেও কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করছে না এমন বাজার বা বহুতলও এ শহরে যথেষ্টই। পরিদর্শক-কমিটির এক সদস্যের কথায়, “কী ভাবে যে এরা পথে আসবে, তা সত্যিই জানা নেই!” |
|
|
|
|
|