দিনভর ঘটনাস্থলে মুখ্যমন্ত্রী |
রাতের আশ্রয়স্থলই আচমকা মৃত্যুপুরী |
কাঁথি থেকে কলকাতায় চাকরি করতে এসে রাত কাটানোর জন্য সূর্য সেন স্ট্রিটের বাড়িটাই বেছে নিয়েছিলেন একটি বেসরকারি মার্কেটিং সংস্থার কর্মী বছর আঠাশের মিঠুন জানা। বুঝতে পারেননি, সেই আশ্রয়ই এক দিন অথৈ জলে ফেলে দেবে পরিবারকে। বুধবার কলকাতা পুলিশ মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর পরিজনদের আকুল কান্নাতেই উঠে এল, মিঠুনের বছর চারের সন্তান ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর প্রসঙ্গ। কী বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দেবেন, জনে জনে সেটাই জিজ্ঞাসা করছিলেন মিঠুনের শাশুড়ি।
|
মিলন পাল। |
শুধু মিঠুনই নন, মঙ্গলবার মাঝরাতে সূর্য সেন স্ট্রিটের আগুন কেড়েছে নদিয়ার তাহেরপুরের পোদ্দার পরিবারের আশ্রয়ও। ছেলে রতনের আলু-পেঁয়াজের দোকানের উপরে এক চিলতে ঘরে রাত কাটাতেন সরকারি কর্মী রাধাগোবিন্দ পোদ্দার। থাকতেন রতনও। আগুনের হল্কা যতক্ষণে ঘুম ভাঙিয়েছে, সব শেষ। বিকেলে মর্গে বসে রতনের মা হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ছেলে-স্বামীর খোঁজ করছিলেন।
মঙ্গলবার রাতেও পিসতুতো দাদা আজিজুল গাজির সঙ্গে কথা বলেছিলেন আজিজুল মোল্লা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যে পুরো ছবিটাই পাল্টে যাবে, ভাবতে পারেননি তিনি। মর্গের সামনে বসে এক মনে বলছিলেন, “রাত এগারোটায় কথা বলার সময়েও ভাবিনি দাদার দেহ নিতে আসব। আর এক দাদা হাফিজুলও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।”
আগুনে মৃতদের মধ্যে রয়েছেন রায়দিঘির মতিরুব মির (২৭)। বাজারেই একটি খাবারের দোকানে কাজ করতেন তিনি। রাতে ঘুমোতেনও সেখানেই। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন হাবরার বাসিন্দা মিলন পাল। মিলন শিয়ালদহে একটি পানের দোকানে কাজ করে রাতে সূর্য সেন মার্কেটে মালিকের ঘরে ঘুমোতেন।মৃতদের পরিজনদের টুকরো টুকরো কথাবার্তা যেন এক ঝলকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বরে। সে দিন আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের পরে এমনই ছবির সাক্ষ্য ছিল এসএসকেএম হাসপাতালের মর্গ। শুধু তাই নয়, সে দিন হাসপাতালে গোটা ময়না-তদন্তের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন পুলিশমর্গে তিনিই ছিলেন মূল ‘সেনাপতি’। কখনও মাইক হাতে বলছেন, “এই পুলিশ ভাই, মৃতদের পরিবারদের এগিয়ে আসতে দিন।” কখনও নিজেই মৃতদের নাম ধরে পরিবারের খোঁজ করছেন। গোটা কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর পাশে রইলেন কলকাতার কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ উচ্চপদস্থ কর্তারা। হাজির রইলেন আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, স্বাস্থ্যমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম-সহ দলের নেতারা।
বেলা এগারোটা নাগাদ ঘটনাস্থলে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়েই রওনা দেন মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে পুলিশ মর্গে। থানার অফিসারেরা ততক্ষণে টেবিল পেতে মৃতদের নাম-ঠিকানা বা ময়না-তদন্তের কাগজ তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সেই টেবিলেই চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী। হাতে পুলিশের মাইক। আর তাতে একের পর এক নির্দেশ। কখনও পুলিশকর্তাদের, কখনও তার লক্ষ্য দলের নেতারা। বললেন, “দেহ বাড়িতে পৌঁছনোর খরচ সরকারের।” |
ময়না-তদন্তের কাজ চলাকালীন আসেন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও। রাজনৈতিক সৌজন্য দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী। মৃতদের নাম-ঠিকানা মিললেই মাইকে তা জানিয়ে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। বেলা পৌনে তিনটে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা: “১৯টি মৃতদেহের ময়না-তদন্ত হয়ে গিয়েছে। শনাক্তকরণ হয়েছে ১৩ জনের। শনাক্ত না হওয়া দেহগুলি পুলিশমর্গেই থাকবে। পরে মুচিপাড়া থানায় এলে দেহ সম্পর্কে খোঁজ মিলবে। মিলবে ছবিও।” ইতিমধ্যেই সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে খবর এল, ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও একটি দেহাংশ মিলেছে।
বেলা সওয়া তিনটে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে মমতা জানালেন, ইন্ডোরে একটি অনুষ্ঠান থাকায় বেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বললেন, “সব কমপ্লিট করে গেলাম।” |