সূর্য সেন বাজারে গিয়ে মৃতদের পরিবারপিছু দু’লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগুনের পিছনে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখার কথা বলেন তিনি। তারও আগে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান অগ্নিদগ্ধ বাড়িটি বাম আমলের বলে মন্তব্য করেছেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই। আর এ সবের জেরেই এমন বিপর্যয়ের দিনেও দেখা দিল রাজনৈতিক বিতর্ক। যা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল আমরি-কাণ্ডের দিন।
দমকলমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে বুধবার প্রথম প্রতিক্রিয়া এসেছে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের তরফে। মুখ্যমন্ত্রীর আগেই তিনি পৌঁছেছিলেন ঘটনাস্থলে। জাভেদ যে ওই বাড়ির দায় আসলে বামেদের ঘাড়েই চাপিয়েছেন, তা জেনে সূর্যবাবুর প্রতিক্রিয়া ছিল, “ওঁরা এই সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারেন! কিন্তু আমার একটা দায়িত্ব আছে।” পরে অবশ্য মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ওই বাড়িটি ৫০ বছর আগের! একই দলের মন্ত্রী এবং মেয়রের বক্তব্যে এই ফারাক নিয়ে বামেরা অবশ্য কোনও মন্তব্যে যাননি। তবে সিপিএমে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “হাততালি কুড়োনোর কথা না-বলে প্রকৃত তদন্ত করুন! কারা দায়ী, খুঁজে বার করুন!” সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্তেরও বক্তব্য, “প্রকৃত কারণ খুঁজে না-বার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য মন্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়!”
প্রশ্ন উঠেছে আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়েও। বিমানবাবু বলেছেন, “চোলাই মদ খেয়ে মৃতের জন্য দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। এখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের দোষ ছিল না। তা হলে এঁদের সঙ্গে চোলাই মদে মৃতদের এক করে দেখা উচিত নয়।” নির্দিষ্ট কোনও অঙ্কের কথা অবশ্য বলতে চাননি সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক।
মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষতিপূরণ ঘোষণার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমনেরও বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন, এটাই বড় কথা। পাশে আছি, হাত ধরে এই কথাটা বলছেন এই ভাবেই মমতাকে দেখতে সকলে অভ্যস্ত। গেলাম আর গিয়েই টাকা ঘোষণা করলাম, এতে মন খারাপ হয়ে যায়!”
রাজনৈতিক বিতর্ক পাশে সরিয়ে রাখলেও মমতা-সরকারের ক্ষতিপূরণ-তথ্যই যথেষ্ট চমকপ্রদ! বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সারা বছরে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু রাজ্যে পর পর ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দুর্ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী নাগাড়ে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করায় ইতিমধ্যেই সেই খরচ সাড়ে তিন কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে ৯১ জন, মগরাহাটে বিষমদে মৃতদের ৩৫টি পরিবার, সাঁইথিয়া রেল দুর্ঘটনায় ২৭ জন, লোবা গ্রামে গুলিচালনায় মৃত গ্রামবাসী এবং আহত পুলিশকর্মী, তেহট্টে গুলিচালনায় মৃত ব্যক্তির পরিবার এবং এ দিন সূর্য সেন স্ট্রিটের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ। যে হারে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, তাতে চলতি আর্থিক বছরে বাড়তি বাজেট বরাদ্দ চেয়ে অর্থ দফতরকে চিঠি দেবে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর।
রাজ্য সরকারে কুড়ি মাস এবং পুরসভায় তিন বছর পেরিয়ে গেলেও যে কোনও ঘটনায় তৃণমূল যে ভাবে দায় এড়াতে ব্যস্ত, তা নিয়ে এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। বিধায়ক মানস ভুঁইয়া কিন্তু আবার বলেছেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি, এখন বিতর্কের সময় নয়। এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করবে কংগ্রেস।” অগ্নিকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন জানিয়ে মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল গাঁধীকে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন মানসবাবু। যার ফলে দলের মধেই গুঞ্জন উঠেছে, প্রাক্তন জোটসঙ্গীর সঙ্গে সুসম্পর্কের দরজা কি খুলে রাখতে চাইছেন প্রাক্তন মন্ত্রী?
মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে এ দিন মমতা-মানস সাক্ষাৎ হয়। তার আগে দলের অপর দুই বিধায়ক নেপাল মাহাতো এবং অসিত মালকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মানসবাবু। পরে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে আমি বলেছি, একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে আগুন লাগার তদন্ত করা দরকার। কারণ, গত দেড় বছরে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এই তদন্তের ব্যাপারে কোনও রকম শিথিলতা দেখানো চলবে না।” |