ভেবেছিলাম, দাদার মতো আমিও শেষ হয়ে যাব। ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
আগুন থেকে বাঁচতে একটা পিচবোর্ডের বাক্সের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম। গায়ে প্রচণ্ড তাপ লাগছে। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। ধরেই নিয়েছিলাম, মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি। আর কয়েকটা মুহূর্ত বাকি আছে কেবল। মায়ের মুখটা শুধু বারবার মনে পড়ছিল। ঘরে বাকিরা সবাই তত ক্ষণে শেষ। আমার দাদা লালচাঁদও। তার পরে আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলাম দমকলকর্মীরা আমাকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলছেন।
আমাদের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে। বুড়ো বাবা-মাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের সংসার। আমি আর দাদা দু’জনেই এই বাড়িতে কাগজের কাপ-প্লেটের দোকানে কাজ করি। বেশির ভাগ দিনই কাজ শেষ হওয়ার আগে শিয়ালদহ থেকে লাস্ট ট্রেনটা ছেড়ে যায়। আমরা হুইসলের শব্দ শুনেই বুঝতে পারি ট্রেন চলে গেল। আর বাড়ি ফেরা হবে না। বাধ্য হয়ে তখন দুই ভাই দোকানঘরেই শুয়ে পড়ি। ঘরে গুচ্ছের পিচবোর্ডের বাক্স, প্লাস্টিক জড়ো করা থাকে। সেগুলোই মেঝেয় পেতে, মাথায় দিয়ে কোনও মতে রাতটা কেটে যায়। পরের দিন সকাল থেকে আবার কাজে লেগে পড়তে হয়। |
মঙ্গলবারও সেটাই হয়েছিল। দোকানের আরও কয়েক জন কর্মী আমাদের সঙ্গে থেকে গিয়েছিল। সকলে মিলে খানিকটা গল্পগুজব করে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে শুয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত তখন ক’টা, বলতে পারব না। হঠাৎ দম আটকে ঘুম ভেঙে গেল। কোনও রকমে চোখ খুলে দেখি, চার পাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি প্রথমে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওই অবস্থায় হাতড়ে হাতড়ে দু’এক পা এগোতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আগুনের আলোয় দেখি, আমার পাশে যারা শুয়েছিল তারা কাতরাচ্ছে, চিৎকার করছে। কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই কেমন নেতিয়ে পড়ল।
আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, দাদা কোথায় গেল? ওর মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে দাদাকে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। দাদার গলাও পেলাম এক বার। কাঁদতে কাঁদতে দাদা কাকে যেন একটা ফোন করছে। ককিয়ে ককিয়ে কথা বলছে। কিন্তু দাদার কাছ অবধি পৌঁছতে পারিনি। একটু পরে ওর গলা থেমে গেল। তবে কি এই ঘরের সবাই মরে গেল? আমি কি বাঁচব? অল্প আলোয় মরিয়া হয়ে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, কয়েক পা দূরে ডাঁই করে রাখা আছে পিচবোর্ডের বাক্স। কী করব ভেবে না পেয়ে ওই বাক্সের ভিতরেই ঢুকে পড়লাম। দম বন্ধ হয়ে বুক ফেটে যাবে মনে হচ্ছিল। কখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি, জানি না।
জ্ঞান ফিরতে দেখি, দমকলকর্মীরা অ্যাম্বুল্যান্সে তুলছেন। তা হলে সত্যিই ওই ঘরটা থেকে আমি বেরোতে পেরেছি? নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। খুব কাশি হচ্ছিল। শ্বাসকষ্টও। অনেকটা ধোঁয়া ভিতরে গেছে। পায়ের পাতা দুটো ঝলসে গিয়েছে।
হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জানতে চাইলেন, কেমন আছি। আশ্বাস দিলেন, আঘাত খুব গুরুতর নয়। ভয় নেই। ডাক্তারবাবুরাও বারবার তাই বলছেন। আমি কী বলব? চোখের সামনে দাদাটা মরে গেল, আর আমি মরতে মরতে বেঁচে গেলাম! কত বয়স হবে ওর? মা বলেছিল, দাদা আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আমার এখন ২৩ চলছে। কাউকে বোঝাতে পারব না, আমার ভিতরটায় যে কী চলছে!
|