শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা ধর্মঘটের মোকাবিলায় প্রশাসকের ভূমিকা পালন করতে চান বলে সোমবার ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই কাজে তাঁর সরকার কতটা তৎপর, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠল।
কাল, বুধবার সকাল ৬টা থেকে দেশ জুড়ে ৪৮ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। (বৃহস্পতিবার, ২১ তারিখ, এ রাজ্যে অবশ্য শুধু শিল্প ধর্মঘট করা হবে বলে জানিয়েছে সিটু। পরিবহণ শিল্প সেই ধর্মঘটের আওতায় থাকবে না।) সোমবার মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানালেন, ধর্মঘট ডেকে জোর করে সাধারণ জীবনযাত্রা বন্ধ করার চেষ্টা বেআইনি বলে কলকাতা হাইকোর্ট যে মতামত দিয়েছে, রাস্তায় নেমে মাইকে তা প্রচার করবে রাজ্য সরকার। এ দিন বিকালে মহাকরণে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। নিয়মমতো, সরকারি নির্দেশের প্রতিলিপি ব্লক স্তরে পৌঁছনোর কথা। রাজ্য প্রশাসনের একাধিক অফিসারের বক্তব্য, বিকেলে ওই বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ায় এ দিন তা জেলায় পৌঁছে দেওয়া যায়নি। আজ, মঙ্গলবার তা জেলাগুলিতে পাঠানোর কথা। বিজ্ঞপ্তি হাতে পেয়ে তার পর মাইকে সর্বত্র প্রচারের ব্যবস্থা করা কার্যত অসম্ভব বলেই জানাচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা। |
আমতলার অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার।—নিজস্ব চিত্র |
সরকারি কর্তাদের বক্তব্য, হাইকোর্ট তার মত দিয়েছে গত বৃহস্পতিবার। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে সরকারকে কড়া পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছে তারা। তার পরের তিন দিন ছুটি জেনে বৃহস্পতিবারই বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারত সরকার। তা হলে অন্তত মাইক-প্রচারের জন্য দু’দিন সময় পেত জেলা প্রশাসন। এক কর্তার প্রশ্ন, “পুলিশ কমিশনারকে সরাতে যদি কয়েক মুহূর্ত লাগে, তা হলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি জারি করতে এত সময় লাগল কেন?
কথায় কথায় ছুটি ঘোষণা করতে অভ্যস্ত মুখ্যমন্ত্রীর বনধ-বিরোধী অবস্থান সাধারণ মানুষের মনে কতটা সাড়া ফেলবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “ধর্মঘটের দিন আসুন। আমি তো ছুটি দিতে কসুর করি না। পুজোর সময় ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছি। এ বারও বাড়িয়ে দেব। কিন্তু ধর্মঘট সমর্থন করবেন না।” প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে কোনও ছুতোয় ছুটি পাওয়ার অভ্যাস তৈরি করে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রীই। ফলে বনধের পড়ে পাওয়া ছুটি উপভোগ করার ইচ্ছা জয় করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হবে।
বিরোধীদের ডাকা বনধ ব্যর্থ করতে সরকার অবশ্য অন্যান্য বারের মতো কড়া অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা করে রেখেছে। নতুন সরকারের আমলে রাজ্যে তিন বার বনধ বা সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে বিরোধীরা। প্রতি বারেই সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি বামপন্থী দলগুলির ডাকা বন্ধে সরকারি কর্মীরা কাজে যোগ না-দিলে চাকরিতে ছেদ বা ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ করার হুমকি দেয় সরকার। ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিত কর্মীদের এক দিনের বেতন কাটে সরকার। এ বারের নির্দেশেও ওই দু’দিন কোনও ছুটি মঞ্জুর করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যসচিব।
|
দোকান-বাজার-স্কুল খোলা রাখুন। কোনও ক্ষতি হলে আমি ক্ষতিপূরণ দেব। আমি আপনাদের পাশে রয়েছি। আমি আপনাদের পাহারাদার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
সরকারি দফতর চালু রাখার চেষ্টার পাশাপাশি এ দিন সাধারণ মানুষকেও ধর্মঘট মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, মানুষ রাস্তায় নামলে তাঁর সরকার নিরাপত্তা দেবে। মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান, “বিরোধীদের ডাকা ধর্মঘটে আপনারা আত্মসমর্পণ করবেন না। দোকান-বাজার-স্কুল খোলা রাখুন। কোনও ক্ষতি হলে আমি ক্ষতিপূরণ দেব। আমি আপনাদের পাশে রয়েছি। আমি আপনাদের পাহারাদার। কিন্তু বিরোধীদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমি পাশে নেই। ক্ষতিপূরণও পাবেন না।” স্কুল কর্তৃপক্ষদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর অভয়, “আপনারা ভয় পাবেন না। স্কুল চালু রাখুন। পড়ুয়ারা আসবে। ওদের নিয়ে ক্লাস করুন।”
ধর্মঘট প্রতিরোধে রাজ্য সরকার প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল থাকবে বলে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “ধর্মঘট বজায় রাখতে কোনও অপরাধমূলক কাজ বরদাস্ত করা হবে না। প্রশাসন কঠোর ভাবে পরিস্থিতি সামলাবে।” দলীয় কর্মীদের প্রতি তাঁর সর্তকবার্তা, “আপনারা ঝান্ডা-ডান্ডা নিয়ে রাস্তায় নামবেন না। যা করার প্রশাসন করবে। ধর্মঘট রুখতে আপনাদের কোনও ভুল আচরণ বিরোধী ও সংবাদমাধ্যম ইস্যু করে নেবে। তার পর বিরোধীরা প্রচার চালাবে।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “আগের বার শিল্প ধর্মঘট রুখতে গিয়ে বাঘাযতীনে তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে সিপিএম পাটি অফিস ভাঙচুর ও সাংবাদিক পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল। ওই ঘটনায় রাজ্য সরকার অস্বস্তিতে পড়েছিল। বিরোধীরাও অস্ত্র পেয়ে গিয়েছিল।”
ধর্মঘট রুখতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা উড়িয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “উনি যত বলবেন, ধর্মঘট ততই স্বতঃস্ফূর্ত হবে। গত বারও উনি এ সব কথা বলেছিলেন। তা সত্ত্বেও ধর্মঘট সফল হয়েছিল। এ বারও হবে।” ‘আমি আপনাদের পাহারাদার’, মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে কটাক্ষ করে সূর্যবাবু বলেন, “উনি এক জন পুলিশ কর্মী বা কাউন্সিলারের পুত্রকেই রক্ষা করতে পারেন না। এর বেশি আর কী বলব!”
ধর্মঘট মোকাবিলায় এ দিন কলকাতা পুলিশের কর্তারাও বৈঠক করেন। ওই দু’দিন পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতায় জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে বাহিনীকে কড়া হতে বলেছেন নতুন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। রাস্তা বা মেট্রো স্টেশনে অবরোধ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম জানান, বুধ ও বৃহস্পতিবার রাস্তায় ৩০০টি পিকেট থাকবে।
রাস্তায় নামবে ৬০টি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড এবং ২৫টি হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড। প্রত্যেক ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে ৪-৫ জন করে র্যাফের জওয়ান থাকবেন। বিভিন্ন মেট্রো স্টেশন, বাস ও ট্রাম ডিপোয় পুলিশ মোতায়েন থাকবে। শামিম বলেন, “জনজীবনে বাধা দেওয়া হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাগরিকেরা অসুবিধায় পড়লে লালবাজার কন্ট্রোল রুমে (২২১৪-৩২৩০, ২২১৪-৩০২৪) ফোন করতে পারেন।” |