একের পর এক কলেজ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে গিয়ে আখেরে যে ক্ষতিই হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তা মানতে হল তৃণমূলকে। আর সেই উপলব্ধি থেকেই রাজ্য জুড়ে সব কলেজে ছাত্র নির্বাচন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিল সরকার। যে সব কলেজে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে (সোমবারই মনোনয়ন জমা পড়েছে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে) সেখানেও স্থগিত থাকবে ভোট। সোমবার এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে।
তৃণমূলের একটা বড় অংশের মতে, কলেজ ভোট মানেই এখন হিংসা-হানাহানি। এবং তা এমন পর্যায়ে যে বোমা-গুলি, প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। কলেজ দখলে লাভের চেয়ে জনমানসে বিরূপ ধারণা শাসক দলের অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারে।
কলেজ ভোট বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, সামনে একাধিক পরীক্ষা রয়েছে। তার পরে আবার পঞ্চায়েত ভোট। তাঁর কথায়, “হাই মাদ্রাসা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরের পর পরীক্ষা রয়েছে। গণ্ডগোল হলেই পথ অবরোধ হচ্ছে। প্রচুর পুলিশ দিতে হচ্ছে। এটা একটা বৃহত্তর স্বাথের্র্র ব্যাপার। এর পরে পঞ্চায়েত ভোট আছে। এই কারণেই কলেজ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকছে ছ’মাসের জন্য। যদিও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আপাতত ছ’মাস বন্ধ থাকছে। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।” ইতিমধ্যে যে সব ছাত্র সংসদের মেয়াদ ফুরোবে, তাদের কী হবে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “ছাত্র সংসদ যেখানে যেমন আছে, আগামী ছ’মাসও তা-ই থাকবে। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও।”
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় রাজনীতির দাপট এ রাজ্যে নতুন নয়। কলেজের নির্বাচন এখানে কার্যত মিনি বিধানসভা নির্বাচনের চেহারা নেয়। বিগত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার তাণ্ডব বেড়েছে। রায়গঞ্জ, মাজদিয়া কলেজ দিয়ে এ পর্বে হানাহানির সূত্রপাত। তার পরে নানা জেলা ঘুরে খাস কলকাতায় এসে তা বিস্ফোরক চেহারা নিয়েছে। গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার বোমাবৃষ্টি হয়েছে, গুলি চলেছে। দুষ্কৃতীর গুলিতে এক পুলিশ কর্মী নিহতও হয়েছেন।
এই ঘটনায় দু’টি বিষয় প্রকাশ্যে চলে এল বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা। প্রথমত, প্রমাণ হল, খাস কলকাতাতেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্য প্রশাসন ব্যর্থ। দ্বিতীয়ত, সেই ঘটনার জেরে বিদ্বজ্জন থেকে সাধারণ মানুষ, সবার মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সামান্য কলেজ নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের জড়িয়ে পড়াটা সাধারণ মানুষ মোটেই ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। এর পরেও এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেও তার প্রভাব পড়তে পারে বলে তৃণমূলের অন্দরেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দলীয় সূত্রে খবর, মমতাকে সেই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনও কোনও সদস্য। গার্ডেনরিচে হাঙ্গামার দিন রাজ্যপালও বলেন, তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিকরণ এবং ক্যাম্পাসে হিংসার বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের বিষয়টি দেখা উচিত। সব দিক বিচার করে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে আর কলেজ নির্বাচন করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না তৃণমূল।
|
|
হিংসা বন্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ এটি। এ বার দেখা যাবে, এর জেরে ছাত্রছাত্রীদের সত্যিই ক্ষতি হচ্ছে কি না। স্থায়ী ভাবে হানাহানি বন্ধ করার জন্য এর পরে সরকারকে ইতিবাচক বিকল্পের কথা ভাবতে হবে।
সুকান্ত চৌধুরী
অধ্যাপক |
|
ব্রাত্যবাবু অবশ্য এই ঝুঁকির কথা মানতে চাননি। তাঁর যুক্তি, “পরীক্ষার সময় স্কুলে স্কুলে পুলিশি বন্দোবস্ত রাখতে হয়। এই সময়ে কলেজগুলোয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলে, সেখানেও পুলিশ রাখতে হবে। একই সঙ্গে দুই জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না।”
রাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষকদের কেউ কেউ বেশ কিছু দিন ধরেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সতর্ক করছিলেন। বিশিষ্ট অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর মতে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভালমন্দের সঙ্গে ছাত্র সংসদের কোনও সম্পর্ক থাকে না। তিনি কলেজে ছাত্র সংসদ রাখারই পক্ষপাতী নন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং হিংসা যে হেতু সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই আপাতত ওই নির্বাচন বন্ধ রাখাই শ্রেয়। পরে বিচার করে দেখা দরকার, ওই সিদ্ধান্ত ঠিক কি না।
সরকারের সিদ্ধান্ত জানার পরে সুকান্তবাবু বলেন, “হিংসা বন্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ এটি। এ বার দেখা যাবে, এর জেরে ছাত্রছাত্রীদের সত্যিই ক্ষতি হচ্ছে কি না। স্থায়ী ভাবে হানাহানি বন্ধে এর পরে সরকারকে ইতিবাচক বিকল্পের কথা ভাবতে হবে।” আশিসবাবু এ দিন জানান, এই ছ’মাস যদি পঠনপাঠনের পরিবেশ ফেরাতে সাহায্য করে, তবে রাজ্য সরকারের উচিত হবে, এই স্থগিত প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত করা। আইআইএম-কলকাতার অধ্যাপক অনুপ সিংহ অবশ্য মনে করেন, ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন স্থগিত থাকাই ভাল।
সরকারি সূত্রে খবর, ছ’মাস বাদে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকার নেয়, তা হলেও লিংডো কমিশনের সুপারিশমতো তৈরি বিধিতেই তা করতে হবে। লিংডো কমিশনের প্রথম সুপারিশই হল, ছাত্র নির্বাচনের সঙ্গে দলীয় রাজনীতির সংশ্রব এড়াতে হবে। বিধি প্রণয়নের ব্যাপারে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই একটি কমিটি গড়ে সুপারিশ তৈরি করেছে। তার সঙ্গে লিংডো কমিশনের সুপারিশগুলি আরও এক বার পর্যালোচনা করা হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই কলেজে নির্বাচন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছে তৃণমূল এবং সিপিএমের ছাত্র সংগঠন। সরকারের সিদ্ধান্তকে এ দিন স্বাগত জানিয়েছে টিএমসিপি।
অন্য দিকে, এসএফআই মনে করছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে গার্ডেনরিচ মডেল আসলে ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই রাজ্য সরকার ভোট স্থগিত রাখছে। |