প্রবন্ধ ২...
সাধারণ শ্রমিকের সায় নেই
সারা দেশে দু’দিনের ধর্মঘট ডেকেছে ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। একই দাবিতে এর আগেও তারা ধর্মঘট ডেকেছে। দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের সর্বত্র ন্যূনতম মজুরি দশ হাজার টাকা করা, ঠিকাশ্রম ব্যবস্থার বিলোপসাধন, বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণ, এফ ডি আই বিরোধিতা ইত্যাদি। যারা এই ধর্মঘটের আহ্বায়ক, তাদের মধ্যে গোটা ছয়েক কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা রয়েছে, যাদের অভিভাবক বা সহযোগী রাজনৈতিক দল দেশের বিভিন্ন রাজ্য বা কেন্দ্রে কোনও না কোনও সময় সরকারে ছিল বা আছে। তারা কি নিজ নিজ সরকারের তরফে এই দাবিকে মান্যতা দিয়েছে? যেমন ধরুন, ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি। দাবি হল মাসিক দশ হাজার টাকা করতে হবে। অর্থাৎ দিন পিছু ৩৩৩ টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে এক নির্দেশে জানিয়েছে দৈনিক ১১৫ টাকার নীচে কোনও পেশায় সরকার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে না। এ ছাড়া ঠিকাশ্রম ব্যবস্থায় বিলোপ, শ্রমআইন কার্যকর করা, এ সবই তো রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে (শ্রম সংবিধানে যুগ্ম তালিকাভুক্ত)। প্রশ্ন হল, তবে কেন রাজ্য সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিলেন না?
এই ধর্মঘটে সারা দেশে সবচেয়ে সক্রিয় সি আই টি ইউ, এ আই টি ইউ সি-র মতো সংগঠনগুলি। তারা তো এই পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বামফ্রন্ট শাসন চালিয়েছে বা চোখের মণির মতো রক্ষা করেছে, তারা কেন এক বারও তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তোলেনি! ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনে (১৯৫৭) গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে ২৭০০ ক্যালরি ধরে সরকার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে না, এটা অনৈতিক এবং বেআইনি কাজ, যা প্রায় ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট সরকার করে গিয়েছে। সে দিন কি নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটিও ধর্মঘট ডেকেছে? বামফ্রন্ট সরকার ২০০০ সালে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বই ছাপিয়ে দাবি করল, দেশের বেশ কয়েক জন পুষ্টিবিজ্ঞানী ২২০০ ক্যালরি ধরে পুষ্টির স্বপক্ষে মত দিয়েছেন। ২০০৬-এর লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে বামফ্রন্ট বলল, পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মেনে মজুরি নির্ধারণ করা হবে এবং একে লঙ্ঘন করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এ সব কথার কথা, বাস্তবে কিছুই হয়নি। আজ রাজ্যপাট চলে গিয়েছে, তাই শ্রমিকদের প্রতি দায়দায়িত্ব বেড়েছে! সে জন্যই রাজ্যে এ সব নিয়ে প্রচার! সাড়ে তিন দশকের শাসনে রাজ্য সরকার বেসরকারিকরণ করেনি? কোথায় সি আই টি ইউ-রা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে? উল্টে, যাঁরা সে দিন বিরুদ্ধে বলেছেন তাঁদের ষড়যন্ত্রকারী, সরকার-বিরোধী আখ্যা দিয়ে শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত করা হয়েছে।
এটা ঠিক যে, সারা দেশের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজ্যেও রেগুলার শ্রমিকের তুলনায় ক্যাজুয়াল শ্রমিক বেড়েছে। সরকারি সংস্থায় সাফাই কর্মী, ক্যান্টিন কর্মচারী, ড্রাইভার, মালিসহ সাব-স্টাফ ঠিকাশ্রমিক নিয়োগ হয়েছে। দেশে ১০০টি সংস্থায় সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে সিমেন্ট, লোহা, স্টিল এবং বস্ত্র শিল্পে ১৯৯৭-৯৮-এর তুলনায় ২০০৩-০৪-এ ঠিকাশ্রমিক বেড়েছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট শিল্প ধরে এই সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে চট শিল্পে এবং গুজরাতে বস্ত্রশিল্পে মোট শ্রমিকদের মধ্যে ৭০-৭৫ শতাংশ ঠিকাশ্রমিক। ২০১১ সালের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে ৪১ কোটির মতো শ্রমিকের মধ্যে ফ্যাক্টরি সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক সাড়ে ৪ কোটির মতো, যার ২ কোটি ৫০ লক্ষ ঠিকাশ্রমিক।
প্রশ্ন উঠেছে, কাকে বলা হবে ‘শোভন কাজ’ (decent work)? আই এল ও-র ব্যাখ্যায় ‘শোভন কাজ’ বলতে বোঝায়, কোনও নারী বা পুরুষশ্রমিক যে কাজে যুক্ত থাকবেন, তাতে স্বাধীনতা থাকবে, বৈষম্য থাকবে না, সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন কাজ হবে। বেতনভুক কর্মসংস্থান, স্বনিযুক্তি, গৃহশ্রম ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। এর বিরুদ্ধ মতও আছে। যাঁরা বলেন, ‘কাজ না থাকার চেয়ে খারাপ কাজ, খারাপ বেতন ভাল’ অর্থাৎ কাজকে শুধু কাজ হিসেবে দেখা হোক। কাজের আবার শোভন/অশোভন কী? জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় (১৯৯৯-২০০০, ৫৫ রাউন্ড) দেখা যাচ্ছে, দেশে গ্রামীণ ক্ষেত্রে মোট পুরুষকর্মীর মধ্যে ৫৫ শতাংশ স্বনিযুক্ত, নিয়মিত কর্মী ৮.৮ শতাংশ, ক্যাজুয়াল শ্রমিক ৩৬.২ শতাংশ। ১৯৯৯-২০০৪-এ দেশে যে ৬ কোটি নতুন কাজ সৃষ্টি হয়েছে, এর মাত্র ৮৫ লক্ষ সংগঠিত ক্ষেত্রে। বাকি পুরোটাই ইনফর্মাল সেক্টর। ক্যাজুয়াল শ্রমিক নিয়োগ বাড়ছে, কারণ, নিয়োগকর্তা খুশি মতো ছাঁটাই করতে পারেন।
পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র শ্রমিকরা সাধারণ ভাবে ধর্মঘটের পক্ষে নয় কেন? তাঁরা দাবিগুলোকে অন্যায্য মনে করেন? তা হয়তো নয়, আসলে তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় যে সব না পাওয়া, বঞ্চনা, অপ্রাপ্তি রয়েছে তার মোকাবিলায় তাঁরা এই সব বড় বড় কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের অধিকাংশকে পান না। ঠিকা শ্রমের পক্ষে, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার পক্ষে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন এই সব ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত নেতৃত্ব। এই যে বছর বছর নিয়ম করে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে তার ফলে সাধারণ শ্রমিক কর্মচারীর কী লাভ হয়েছে?
ধর্মঘটের আইনি অধিকার আছে, প্রশ্নটা সেখানে নয়। ২০০৭ থেকে ২০১০ বছরওয়াড়ি হিসাবে এই রাজ্যে ধর্মঘটজনিত শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে ১৩ লক্ষ থেকে ৯ লক্ষ। এর কারণ স্রেফ সরকারি সমর্থনে প্রতি বছর এক বা একাধিক শিল্প/ সাধারণ ধর্মঘট। তার প্রমাণ: ২০১১-১২’য়, ধর্মঘটজনিত শ্রমদিবস নষ্টের সংখ্যা এক ধাক্কায় কমে হয়েছে ৬০০০।
এই ধর্মঘটে সাধারণ শ্রমিকের সায় নেই। দাবি যতই ন্যায্য হোক, অন্যায্য ধর্মঘটকে হাতিয়ার বলে মানতে তাঁরা নারাজ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.