প্রবন্ধ ১...
শান্তি রক্ষার নামে গুন্ডামিকে প্রশ্রয়
শিস নন্দী বয়সে বড় হলেও কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার বন্ধু। সম্প্রতি উত্তর ভারতের কিছু রাজনৈতিক নেতা যখন দুর্নীতি বিষয়ে জাতিবিদ্বেষী মন্তব্যের দায়ে এই ভদ্র এবং দরদি পণ্ডিত মানুষটিকে জেলে পোরার জন্য শোরগোল তুললেন, তখন খুবই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের সুবিবেচনায় এই উদ্ভট কুনাট্য চটপট থেমে যায়। কিন্তু এই শোরগোল থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই।
তবে তার আগে বলে রাখি, জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে আশিস নন্দী যা বলেছেন বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি, আমার মনে হয়েছে সেটা একটু অদ্ভুত ধরনের। স্রোতের বিপরীতে কথা বলতে গিয়ে তিনি যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন এবং অতিরিক্ত জটিল ভাবে কথাটা বলেছেন। পরে তিনি নিজের কথার মর্ম যে ভাবে ‘ব্যাখ্যা’ করেছেন, তাতেও বিভ্রান্তি কাটানোর ব্যাপারে খুব একটা সুবিধে হয়নি। যেমন পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এক শতাব্দী যাবৎ উচ্চবর্ণশাসিত এই রাজ্য সি পি এমের জমানায় অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় দুর্নীতিমুক্ত ছিল। এই কথা শুনলে প্রথমত এমন একটা ভুল ধারণা জন্মাতে পারে যে, উচ্চবর্ণের মধ্যে যেন দুর্নীতি কম। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, তাঁর এই কথাটাই ভুল। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের মধ্যবর্তী স্তরের আধিকারিকরা প্রধানত উচ্চবর্ণের মানুষ এবং তাঁদের মধ্যে দুর্নীতির প্রকোপ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। এটা সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট পার্টির একেবারে উপরতলার নেতারা, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তুলনায় সৎ। (তাঁদের কারও কারও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে অবশ্য সব সময় কথাটা বলা চলে না।) কিন্তু সে কথা আবার দেশের অন্যান্য রাজ্যের কমিউনিস্ট নেতাদের ক্ষেত্রেও সত্য। এর পিছনে আছে, নেতাদের জাতি বা বর্ণ নয়, তাঁদের দলীয় শৃঙ্খলার ঐতিহাসিক প্রভাব। কিন্তু এক জন পণ্ডিত মানুষ জনপরিসরে একটু অসতর্ক একটা মন্তব্য করেছেন, এমনটা নিতান্ত বিরল নয়। তাই বলে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করতে হবে, এটা সম্পূর্ণ বিদঘুটে এবং ভয়ানক ব্যাপার।
‘মুর্দাবাদ’। আশিস নন্দীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বিক্ষোভ। জয়পুর, ২৭ জানুয়ারি। ছবি: পি টি আই
যে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তার প্রথমটি হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। আশিস নন্দীর যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, আমি তার সঙ্গে একমত না হলেও তাঁর সে কথা বলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বলেই আমি মনে করি। এটা অবশ্যই উদারনৈতিক চিন্তাধারার পরিচিত অবস্থান, যে উদারতা ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তি বা এনলাইটেনমেন্টের একটা উত্তরাধিকার। এটা একটু অদ্ভুত বটে যে, আশিস নন্দী (তাঁর উত্তর-আধুনিক অনুগামীদের সঙ্গে) সারা জীবনের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে ওই এনলাইটেনমেন্ট ধারার তীব্র সমালোচনা করে এসেছেন। ভারতের উদারপন্থীরা অবশ্য জানেন যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের সংবিধান বিশেষ উদার নয়। (লক্ষণীয়, সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় সাংবিধানিক অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়ার পরে আশিস নন্দীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে জনসমক্ষে যা খুশি বলার অধিকার বলে ধরে নেওয়া যায় না।) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনজীবনের শৃঙ্খলা, শোভনতা, নৈতিকতা, ইত্যাদি নানা কারণে স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর নানা নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়। কোনও একটা মতাদর্শের বা ধর্মের অন্ধ অনুরাগী কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠীর যে কোনও একটা বা একদল গুণ্ডা যদি হুমকি দেয় যে, অমুকের কথায় বা লেখায় বা ছবিতে তাদের গোষ্ঠীর মনে ‘সম্ভাব্য’ আঘাত লাগতে পারে, এবং তার পরিণামে যদি জনজীবনের শান্তিশৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়ার সুদূরতম সম্ভাবনাও থাকে, তা হলেই আর দেখতে হবে না বই হোক, চলচ্চিত্র হোক, শিল্পপ্রদর্শনী হোক, সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে যাবে। কী কেন্দ্রে, কী রাজ্যে, ভয়কাতর সরকারকে হুমকি দিয়ে এই ধরনের স্বাধীনতাহানি ঘটাতে বাধ্য করার ঘটনা ইদানীং আকছার ঘটছে, এ ব্যাধি প্রায় মহামারির আকার ধারণ করেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রে গোষ্ঠীগত দৌরাত্ম্য নিয়মিত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে পিষে দেয়। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিরক্ষার নামে আমরা এই ধরনের দৌরাত্ম্য মেনে নিই, ফলে গুন্ডাদের জিত হয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হল ঐতিহাসিক ভাবে অনগ্রসর নিম্নবর্ণ এবং জনজাতির মানুষের মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা। বিভিন্ন বর্গের মানুষের চরিত্রে সাধারণ ভাবে অন্তর্নিহিত সততা বা অসততার প্রকোপ যদি সমান বলে ধরে নিই, তা হলেও এটা মানতে হবে যে, এক একটি বর্গের ক্ষেত্রে এক এক রকমের সমস্যা, সুযোগ এবং চাপ কাজ করে, সুতরাং বাস্তব অবস্থায় তাদের মধ্যে নানা গুণ বা দোষের মাত্রা কী দাঁড়াবে, সেটা এক রকম না-ই হতে পারে। মনে করা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক জন শ্বেতাঙ্গ গবেষক পরিসংখ্যানে দেখলেন যে, বড় শহরগুলোয় জনসংখ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের যে অনুপাত,, অপরাধীদের মধ্যে তাঁদের অনুপাত তার চেয়ে বেশি। তিনি এই তথ্য জানালে সেই কারণেই তাঁকে বর্ণবিদ্বেষী বলা ঠিক হবে কি? অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের প্রভাব আছে, যার ফলে পুলিশ এবং বিচারকরা অনেক সময়েই কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন। কিন্তু তার পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিক কারণও আছে, যেমন যথাযথ শিক্ষা, উপযুক্ত কর্মসংস্থান বা সুস্থ জীবনযাপনের অন্যান্য সুযোগের অভাব অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে অপরাধজগতে ঠেলে দেয়। একই ভাবে, ভারতে নানা আর্থিক ও সামাজিক কারণে বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে কখনও কখনও নানা ‘দুর্নীতিমূলক’ কাজকর্মে যোগ দিতে বা মদত দিতে দেখা যেতে পারে, এমনকী উচ্চবর্ণের তুলনায়ও। এ রকম দুটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করা যাক:
(১) একটা কারণ হল সামাজিক যোগাযোগের তারতম্য। (আশিস নন্দী সম্ভবত এই ব্যাপারটাই বলতে চেয়েছিলেন।) উচ্চবর্ণের মানুষ বহু শতাব্দী যাবৎ ক্ষমতা এবং সুবিধা ভোগ করে এসেছেন। ফলে ঠিক ঠিক জায়গায় ঠিক ঠিক লোক তাঁদের চেনা থাকে, তাই তাঁদের বহু দরকারি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের চাকরি পেতে, কনট্রাক্ট বা ইজারা পেতে সুবিধে হয়। এটাই তো নেটওয়ার্কের মহিমা। সাধারণ ভাবে নিম্নবর্ণের সেই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকে না। এই অবস্থায় নিম্নবর্ণের এক জন মানুষ উপরে ওঠার সুযোগ পেলে টাকা দিয়ে নেটওয়ার্কের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতেই পারেন। সেটা দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়, কিন্তু উচ্চবর্ণের মানুষ যখন নিজের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সুবিধে আদায় করেন তখন সচরাচর দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয় না। তা ছাড়া, যথেষ্ট যোগাযোগ না থাকার ফলে নিম্নবর্ণের মানুষের দুর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। এই দ্বিচারিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কি জাতপাতের বশীভূত হওয়া?
(২) একটা সামাজিক গোষ্ঠী যদি বহু কাল ধরে বঞ্চনা এবং অপমানের শিকার হয়ে থাকে, তা হলে সুশাসনের তুলনায় তারা মর্যাদার রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিতেই পারে। তাই অনেক সময়েই দেখা যায়, নিম্নবর্ণের এক জন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা তাঁর সমবর্ণের মানুষের সমর্থনে একের পর এক নির্বাচনে জয়ী হয়ে চলেছেন। তার কারণ, ওই নেতা গোটা একটা গোষ্ঠীর আত্মসম্মান এবং মর্যাদা বাড়িয়ে তোলার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকী নেতার দুর্নীতিকে হয়তো একটা প্রশ্রয়ের চোখেও দেখা হয়: এত কাল উচ্চবর্ণের লোকেরা সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছে, এ বার ‘আমাদের পালা’! উত্তর ভারতে বহু কাল যাবৎ পিছিয়ে থাকা নানা গোষ্ঠী সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতার বলয়ে আসতে পেরেছে, সেখানকার রাজনীতিতে এই প্রতীকী গোষ্ঠী-স্বাভিমানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (দক্ষিণ ভারতে আত্মমর্যাদার দাবিতে আন্দোলনের ইতিহাস অনেক বেশি পুরনো, সেখানে নিম্নবর্ণের নেতাদের কাছে প্রতীকী মর্যাদার চেয়ে সুশাসনের দাবি সচরাচর অনেক বেশি।)
উত্তরপ্রদেশের ১০২টি বিধানসভা কেন্দ্রের এলাকায় রাজনৈতিক দুর্নীতির এক সমীক্ষা করেছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রোহিণী পান্ডে। প্যারকিয়াল পলিটিক্স: এথনিক প্রেফারেন্সেস অ্যান্ড পলিটিশিয়ানস’ করাপশন নামে তাঁদের গবেষণা-প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় কেনেডি স্কুল ওয়ার্কিং পেপার (হার্ভার্ড, ২০০৯) হিসাবে। তাঁরা দেখিয়েছিলেন, ১৯৮০ থেকে ১৯৯৬, এই সময়ে কেন্দ্রগুলিতে ভোটের জাতপাতভিত্তিক মেরুকরণের মাত্রা বেড়েছিল এবং বিজয়ী প্রার্থীদের গুণমানের (দক্ষতা এবং সততার মাপকাঠিতে) অবনতি ঘটেছিল। তাঁদের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত: রাজনীতিতে জাতিবর্ণভিত্তিক আনুগত্যের প্রভাব যত বাড়ে, রাজনীতিকের গুণগত উৎকর্ষ তত কমে।
সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির কাঠামোর গভীরে নিহিত এই কারণগুলির বিশ্লেষণ করে আমি যতটা বললাম, আশিস নন্দী কিন্তু ততটা বলেননি। আমি কি তবে নিম্নবর্গের মানুষকে আরও বেশি ‘আঘাত’ করলাম? আশিস নন্দীর সমর্থকদের অনেকে বলেছেন, তিনি তো নিম্নবর্ণের জন্য নানা ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণের নীতি সমর্থন করেন, তাই তিনি কী করে নিম্নজাতি-বিদ্বেষী হবেন? কিন্তু আমি তো আবার এই ধরনের সংরক্ষণের প্রশ্নহীন সমর্থক নই। (দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পদের আরও বেশি পুনর্বণ্টন আমি চাই, কিন্তু সংরক্ষণই তার শ্রেষ্ঠ উপায়, এমনটা আমার মতে না-ও হতে পারে।) তা হলে আশিস নন্দীর যে রক্ষাকবচটুকু আছে, আমার তো তা-ও নেই।

সৌজন্য: ‘আইডিয়াজ ফর ইন্ডিয়া’ (ব্লগ)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে’তে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.