পাশের দশটি শয্যা খালি। হাসপাতালের বড়সড় একটা ঘরে একেবারে একা তিনি। অবসাদ চেপে বসছে ক্রমশ। শারীরিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু সদ্যোজাত সন্তানের জন্য হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। সুযোগ পেলে এখনই ফিলিপিন্স-এর ম্যানিলায় বাড়ি ফিরে যেতে চান ক্যামকো জিনা সেপুলভেদা।
মাঝ-আকাশে বিমানের মধ্যে কন্যা প্রসব করেছিলেন। পরিস্থিতি তাঁকে নিয়ে এসেছে এক অচেনা শহরে, কলকাতায়। কিন্তু গত বারো দিন ধরে ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে বয়ে গিয়েছে, তাতে আকাশ থেকে কার্যত জলে পড়ে গিয়েছেন ওই তরুণী। সোমবার তাঁকে কাগজে-কলমে ছুটি দিয়েছে হাসপাতাল, কিন্তু বাড়ি ফেরা এখনও দূর অস্ত্।
ক্যামকো জিনা-র সামনে প্রশ্ন অনেক। কলকাতা থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে ম্যানিলায় কে নিয়ে যাবে তাঁকে? সময়ের আগেই জন্মেছে তাঁর সন্তান। তার ওজনও স্বাভাবিক নয়। তাই তাকে নিয়ে কি বিমানে ওঠা যাবে? কলকাতার হাসপাতালে এত টাকার বিল কে মেটাবে?
তবে জিনা এখন এর থেকেও বড় প্রশ্নের মুখোমুখি। তাঁর বাড়ি থেকে এখনও একটা ফোনও আসেনি। এমনকী, যে বন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে তাঁর এই সন্তানের জন্ম, তাঁর কাছ থেকেও কোনও খোঁজখবর নেই। ‘‘সে কি, আপনার স্বামী জানেন না আপনি এখানে?’’ |
জিনার মুখের আলো নিভে যায় হঠাৎই। বলেন, “আমাদের বিয়ে হয়নি। ও চাকরি করতে দুবাই এসেছিল। তখন আমিও দুবাইয়ে চাকরি করছি। আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। গত বছরই আমার ওই বন্ধু ম্যানিলায় ফিরে গিয়েছে। তত দিনে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছি।” দেশে ফিরলে সেই বন্ধু এখন তাঁকে গ্রহণ করবেন কি না, নিজের বাবা-মায়ের কাছেও আশ্রয় মিলবে কি না সাত পাঁচ ভেবে কুল পান না জিনা। কেবলই চোখ ভিজে আসে।
ফিলিপিনো এই যুবতী ৭ ফেব্রুয়ারি এমিরেট্স-এর বিমানে দুবাই থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পথে মাঝ-আকাশে সন্তান প্রসব করেন। অপরিণত, মাত্র এক কিলো ৯০০ গ্রাম ওজনের শিশুকন্যাকে বাঁচাতে বিমানের মুখ ঘুরিয়ে পাইলট নেমে পড়েন কলকাতায়। হাসপাতালের জিএম ঈপ্সিতা কুণ্ডু সোমবার জানান, জিনার মেয়ের ওজন বেড়ে এখন ২ কিলো ৩ গ্রাম হয়েছে। বিমানবন্দরের চিকিৎসক জানিয়েছেন, এই অবস্থায় সে বিমানে উড়তে পারবে।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, তাদের উড়ানের যাত্রী হিসেবে জিনা-র সব দায়ভার এমিরেটস-কেই নিতে হবে, এমন কোনও আন্তর্জাতিক নিয়ম নেই। এক অফিসারের কথায়, “সুস্থ যাত্রী আচমকা অসুস্থ হলে এক রকম। কিন্তু জিনা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।” ফিলিপিন্স দূতাবাস সূত্রে জানা গিয়েছে, সদ্যোজাত শিশুর ‘ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’ বানানোর জন্য তার ছবি তুলে দিল্লি পাঠানো হয়েছে। তা আরও দু’তিন দিন পরে কলকাতায় এলে ব্যাঙ্কক বা সিঙ্গাপুর ঘুরে মা-মেয়েকে ম্যানিলায় পাঠানো হবে। দুবাই থেকে জিনার বান্ধবী ফোনে জানিয়েছেন, তিনি হাসপাতালের টাকা মিটিয়ে দেবেন। ম্যানিলা না হয় পৌঁছনো গেল। কিন্তু তার পরে কী হবে? জিনার কথায়, “সে রকম পরিস্থিতি হলে ইকে-কে নিয়ে আমি আবার দুবাই ফিরে যাব। আবার চাকরি করব।” আকাশ-কন্যার সদ্য নামকরণ হয়েছে ইকে। প্রতিটি বিমান সংস্থার উড়ানের একটি নির্দিষ্ট কোড থাকে। ‘ইকে’ এমিরেটস-এর উড়ানের কোড। এবং এখন থেকে জিনার মেয়ের নামও। |