বিদায়ী পুলিশ কমিশনার যে দিন বাড়ি গিয়ে চাকরির আশ্বাস দিয়েছিলেন গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে নিহত পুলিশকর্মী তাপস চৌধুরীর মেয়েকে, সদ্যবিধবা মিনতিদেবী সে দিনই জানিয়ে দিয়েছিলেন, মেয়েকে রাস্তায় নেমে কাজ করতে দিতে চান না তিনি। সে রকমই এক পদে সোমবার যোগ দিলেন তনুশ্রী চৌধুরী। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের করণিকের পদে চাকরি হয়েছে তাঁর।
এমনটা চাননি তিনি। কর্তব্যরত অবস্থায় বাবার মৃত্যুতে হঠাৎই সব ওলটপালট। প্রথম দিন অফিসে বেরোনোর আগে ধরা গলায় তনুশ্রী তাই বলেও ফেলেন, “পড়াশোনা শেষ করে নিজের দক্ষতায় চাকরি পেতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, হয় শিক্ষকতা করব, না হয় পুলিশেরই উঁচু কোনও পদে চাকরি করব।”
বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা আর ভাইয়ের কথা ভেবেই নিজেকে কোনও রকমে সামলে রেখেছিলেন। এ দিন বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আর ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে। |
দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে... |
কাজে যোগ দিতে যাওয়ার আগে বাবা তাপস চৌধুরীর ছবির সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তনুশ্রী। |
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তনুশ্রী। পাশে থাকা ভাই জড়িয়ে ধরল তাঁকে। চোখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে মা মিনতিদেবী। তাঁকে প্রণাম করে দুই মামা মধুসূদন ও কালীপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিলেন ওই তরুণী।
মাত্র ছ’দিন আগে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি তনুশ্রীর বাবা তাপস চৌধুরী ঠিক এই সময়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ডিউটিতে। ফিরে আসে তাঁর নিথর দেহ। সে দিন গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র নির্বাচন ঘিরে গোলমালের আশঙ্কায় কলেজের বাইরে ডিউটি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেখানেই দুষ্কৃতীর ছোড়া গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁর। কর্তব্যরত অবস্থায় এসআই তাপসবাবুর মৃত্যু হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, নিহতের মেয়ে তনুশ্রীকে পুলিশের চাকরি দেওয়া হবে। মিনতিদেবীর অনুরোধে তনুশ্রীকে অফিসের কাজেই নিযুক্ত করার কথা বলে আসেন পুলিশের কর্তারা। বলা হয়, সোমবার ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁকে অফিসে যোগদান করতে হবে।
কথা মতো এ দিন সকাল দশটার মধ্যেই তাঁতের শাড়ি, চাদর গায়ে তৈরি ছিলেন তনুশ্রী। ১০টা ৫ মিনিটে তাপসবাবুর সারদাপল্লির বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় পুলিশের গাড়ি, তনুশ্রীকে অফিসে নিয়ে যেতে। আসেন তাপসবাবুরই সহকর্মী পীযূষবন্ধু সেন। দিদিকে তুলে দিতে গাড়ি অবধি যায় ভাই তমাল। এর পরে দুই মামা এবং বাবার সহকর্মীর সঙ্গে তনুশ্রীকে নিয়ে গাড়ি রওনা দেয় লর্ড সিনহা রোডে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসের দিকে। |
সোমবার কাজে যোগ দিলেন তাপস চৌধুরীর মেয়ে তনুশ্রী। তার আগে বাড়িতে। |
অফিসটাইমের ব্যস্ত রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছতে প্রায় এগারোটা। স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন তনুশ্রীর মাসিমা গৌরী ভট্টাচার্য। তনুশ্রী গাড়ি থেকে নামতে অফিসের অন্য কর্মীরা তাঁকে নিয়ে উঠে যান দোতলার একটি ঘরে। সেখানেই তাঁকে বিভিন্ন কাগজপত্রে সই করানো হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য এ দিন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিট, সার্টিফিকেট আর ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল তনুশ্রীকে। ওই অফিসেরই একতলায় একটি ঘরে তাঁর জন্য আলাদা টেবিলের ব্যবস্থা করেন অফিসারেরা। কম্পিউটারের কাজ জানেন বলে তাঁকে পরে একটি কম্পিউটারও দেওয়া হবে বলে অফিসারেরা জানিয়েছেন। ওই বিভাগে মাত্র কয়েক জন কর্মী রয়েছেন। অন্য এক মহিলা অফিসারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হয়েছে তনুশ্রীকে। কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হলে তাঁর কাছেই জানাতে পারবেন তনুশ্রী।
এ দিন তনুশ্রীর কাগজপত্রে সই চলাকালীন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে যান কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (গোয়েন্দা) পল্লবকান্তি ঘোষ। তনুশ্রীকে তিনি বলেন, “পড়াশোনা চালিয়ে যাও। যদি কোনও অসুবিধা হয়, আমরা তোমার পাশে আছি।” তবে আগামী ২০ তারিখ, বন্ধের দিন তনুশ্রীকে অফিসে অতি অবশ্যই আসতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, প্রথম দিকে তনুশ্রীকে পুরনো ফাইলপত্রের কাজ দেওয়ার কথা বলেছেন পল্লববাবু। এ দিন তনুশ্রী অফিসের হাজিরা খাতায় সইও করেন। ঘণ্টা চারেক অফিসে থেকে তিনটে নাগাদ মামাদের সঙ্গেই অফিস থেকে বেরোন তিনি। পরিবার সূত্রে খবর, এর পরে তাঁরা যান বিবেকানন্দ কলেজে। সেখানে কলেজের অধ্যক্ষার সঙ্গে নিজের পড়াশোনার বিষয়ে কথা বলেন তনুশ্রী। চাকরির পাশাপাশি কী করে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন, তা নিয়ে কথা হয়। থিয়োরি ক্লাস না করলেও তিন মাসের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসগুলি করলেই হবে বলে অধ্যক্ষা তনুশ্রীকে জানিয়েছেন। |