|
|
|
|
প্রেম আনন্দ |
শুধু তো ছ’দশকের ম্যাটিনি আইডল নন। ছিলেন ভালবাসার অঘোষিত রাজকুমার।
মৃত্যুতেও থেকে গিয়েছেন চির নায়ক।
ভ্যালেনটাইন’স ডে-র স্বাভাবিক প্রতীক হতে পারেন তিনি।
দেব আনন্দ।
দেড় বছর আগে মারা যাওয়া
সেই রোম্যান্টিক বিগ্রহের স্মৃতিচারণে ঘনিষ্ঠতম সহযোগী
মোহন চুড়িওয়ালা।
মুম্বইয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন গৌতম ভট্টাচার্য |
স্বর্গে এখন কাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারেন: প্রথমেই নিশ্চয় খুঁজেছেন সুরাইয়াকে! এত দিনে নির্ঘাত দু’জনের নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎও হচ্ছে। সুরাইয়াকে উনি কখনও ভুলতে পারেননি। গাড়িতে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাওয়ার সময় সুরাইয়ার মৃত্যুর পরেও দেবসাব সেই কৃষ্ণমহল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বিজয় আনন্দের সেই তালিকায় দ্বিতীয় থাকার সম্ভাবনা। তার পর তৃতীয় লোক গুরু দত্ত। এর পর বর্মনদা, সুধীর লুধিয়ানভি, আর ডি এবং কিশোর কুমার। সরি অশোক কুমারের নামটা আগে আসবে। দাদামণির কাছে উনি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন।
ভ্যালেনটাইন’স ডে: মৃত্যু অবধি টিনএজারের মন নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কোনও দিন দেখিনি মনকে বুড়োটে হতে দিয়েছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখটা ওঁর কাছে আলাদা করে পছন্দের দিন ছিল না। বলতেন, “প্রেমিক মন যার আছে, তার কাছে রোজই ভ্যালেনটাইন’স ডে। খুশির মেজাজ যার আছে, তার মনে রোজই দিওয়ালি।” |
|
দেব-রাজেশ শেষবারের মতো মর্তে দু’জনে একসঙ্গে। পুণে ২০১০।
আশ্চর্য, এটা ছিল তাঁদের জীবনের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ মাত্র |
রুম নম্বর ২২৮, সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেল, জুহু বিচ: দেব সাবের নামের সঙ্গে যেন জুড়ে রয়েছে এই হোটেলটা। ওই একটা ঘর কুড়ি বছরেরও বেশি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আইরিশ পার্কের বাড়ি থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে তিনি হোটেলে চলে আসতেন। এখানেই লোকজনের সঙ্গে দেখা করতেন। প্রাইভেট সিটিং, স্ক্রিপ্ট রিডিং সবই এখানে হত। পৃথিবীতে আর কোনও স্টার দীর্ঘ এত বছর হোটেলের একটা ঘরে এমন নির্দিষ্ট করে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। একটা সময় হোটেলটা হাতবদল হওয়ার মুখে ছিল। তখন ‘গাইড’ সদ্য রিলিজ করেছে। হোটেল মালিক এসে দেব সাবকে বললেন, “একটা ঘর কেন ভাড়া নেবেন? পুরো হোটেলটাই কিনে নিন না।” দেব রাজিও হয়ে গিয়েছিলেন। বাগড়া দেন তাঁর তখনকার প্রোডাকশন ম্যানেজার যশ জোহর। কর্ণ জোহরের বাবা। যশ বলেন, “আপনি কী হতে চাইছেন দেব সাব, ফিল্ম মেকার না হোটেলিয়ার?” এটা শুনে দেব একটু ঝিমিয়ে যান। ভাবেন সত্যিই তো। নইলে আজ হয়তো হোটেল মালিক হিসাবেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতেন।
তাঁর মৃতদেহ মুম্বইয়ে এনে সৎকার না করা: সচেতন সিদ্ধান্তই ছিল যে, সবাইকে ডেকে-ডুকে না দেখানো ক্যামেরার সামনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছেন দেব আনন্দ। মেক আপহীন। নাকে তুলো, কানে তুলো। শরীরের ওপর মাছি ভনভন করছে। এটা তাঁর ভক্তদের দেখানো হবে না। দেব চেয়েছিলেন তাঁর হাস্যমুখ, চির রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজারিটাই মানুষের মনে থাক। এক বার আমায় বলেছিলেন, “ঈশ্বর কেন এমন করেন না যে, মৃত্যু হল আর সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাও উধাও। এই যে বডি মারা যাওয়ার পরেও দাহ হওয়া পর্যন্ত অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকা, এটা আমার কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য নয়।” ইংল্যান্ডে মৃত্যু হওয়ায়, হয়তো আরও সুবিধেই হয়েছিল। উনি মুম্বইয়ে মারা গেলে নিশ্চয়ই দাহ-টাহ করে, তার পর সবাইকে খবর দেওয়া হত। তবে মৃত্যু নিয়ে যে দেব সাবের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা হত এমন নয়। ক্বচিৎ কথাবার্তা উঠেছে। আসলে উনি এত জীবনবিলাসী ছিলেন। জীবনকে এত ভালবাসতেন যে, মৃত্যুর কথা ওঁর মুখে ঠাঁইও পেত না। এক কথায় আলোচনাটা শেষ করে দিতেন। সিমি-কে দেওয়া এক ইন্টারভিউতেও বলেছিলেন, “মৃত্যুকে ভয় পাই না। যখন হবে সামলে নেব।” দারুণ লাগত আমার মৃত্যুকে নিয়ে ভাবনার ধরনটা। রিয়েল স্টার! |
|
দেব আনন্দ-এর সঙ্গে মোহন চুড়িওয়ালা |
রাজ কপূর-দিলীপ কুমারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক: অনেকের ধারণা, জিনাত আমন তাঁকে ছেড়ে রাজ কপূর ক্যাম্পে চলে যাওয়ায় বুঝি আর কে শিবিরের সঙ্গে দেব সাবের সম্পর্কে চিরস্থায়ী ফাটল ধরে গিয়েছিল। ধারণাটা একেবারেই ঠিক নয়। রাজ আর ওঁর, শেষ অবধি বন্ধুত্ব ছিল। দেব গর্ব করে বলতেন, “এক্ষুনি যদি রাজকে ফোন করে ডাকি, ও যে অবস্থাতেই থাক আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে।” আর কে স্টুডিওতে দেবকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করা হত। উনি যখন শু্যটিং করতে যেতেন, রাজ কপূরের মেক আপ রুম খুলে দিত ওরা। অথচ রাজ মারা যাওয়ার পর ওই ঘরটা আর কারও জন্য খোলেনি। এমনিতে বিয়ের নেমন্তন্নে যেতেন না দেব সাব। কখনও যেতে দেখিনি। কিন্তু ঋষি কপূরের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে বলেও যান, “কিছু করার নেই। রাজের ব্যাপার।” দিলীপ সাবকেও উনি খুব ভালবাসতেন। সায়রা বানুর সঙ্গে যখন দিলীপ সাবের শাদি হল, রাজ আর দেব বরযাত্রী গিয়েছিলেন। সেখানেই শেষ নয়, এমনই বন্ধুত্ব ছিল ওঁদের যে, সুহাগ রাতের আগে রাজ আর দেব বর-কনের বেডরুমে ঢুকে পড়েন। ঢুকে ঠাট্টা-ইয়ার্কি-হাসাহাসি। দেব সাবের সঙ্গে আমার যে দিন শেষ কথা হয়, প্রসঙ্গ দিলীপ কুমারই ছিলেন। উনি তখন লন্ডন চলে গিয়েছেন। আমি ফোনে জানাই, সায়রা বানু কল করেছিলেন। দিলীপ সাবের নব্বইতম জন্মদিনে আপনাকে ইনভাইট করেছেন। দেব বললেন, “আমি তো ইংল্যান্ড থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরছি না। তুমি একটা কাজ করো। আমার নাম করে ইউসুফকে একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়ে দিও।” কে জানত, সেই তোড়া পাঠানোর দিনে ওঁকে যে আর ফোনেও পাওয়া যাবে না?
দেব দর্শনের পরম্পরা: একটা পরম্পরা তো উনি তৈরি করে দিয়েছেন ঠিকই। ওঁর ধাঁচের ছবিগুলো সব সময় আধুনিক। একটু ব্যতিক্রমী ভাবনা নিয়ে। সময়ের চেয়ে এগিয়ে। ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ যখন উনি করেছিলেন, তখন হিপিদের ওপর ছবি করা নিয়ে কেউ ভাবেইনি। ‘টাইম স্কোয়ার’ নামের যে ছবিটা করেছিলেন বা ‘মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার’ সেই দু’টো ফিল্মেও সময়ের আগে ভাবা হয়েছিল। বৈচিত্র দেখিয়েছেন। নতুন নতুন ছেলেমেয়েকে সুযোগ দিয়েছেন। একটা সেকেন্ডও ভাবেননি যে, নতুন ছেলে বা মেয়ে থাকলে কী ঝুঁকি হতে পারে। এই ফাটকা খেলার সাহসটা আমার মনে হয়, ওঁর পরম্পরা হওয়া উচিত। ফিল্মের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে উনি জড়িয়ে থাকতেন। এডিটিং-মিক্সিং-শু্যটিং-ডাবিং। ওঁর ছবিতে প্রতিটি সেকেন্ডই ওঁর নিজের দেখে ছাড়া। প্রতিটা পয়সা ওঁর নিজের পয়সা। বাইরে থেকে এক টাকাও কখনও নেননি। ওঁর নিজের লোকেদের সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক ছিল। সে ক্যামেরাম্যান হোক কী আর্ট ডিরেক্টর। আমি মনে করতে পারি না, নবকেতন থেকে কোনও কর্মচারী কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছে বলে। তার চাকরিতে ছেদ পড়া মানে, হয় স্বাস্থ্য আর দেয়নি, নইলে সে মারা গিয়েছে। ‘মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার’য়ের দু’টো র্যাপ গান লিখেছিলেন নিজে। একটা ইংরেজি, একটা হিন্দি। গানের কথা খুব ভাল বুঝতেন। নিজের ছবির প্রতিটা গানের লাইনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন। |
|
সুরাইয়া ও জিনাত আমন |
ছবি বানানোর দেব মডেল: অনেকে হেসেছে, তীব্র ব্যঙ্গ করেছে। কিন্তু দেব সাব ছবি বানিয়েই গিয়েছেন। ছিদ্রান্বেষীদের পাত্তা দেননি। বলতেন, “চার-পাঁচটা লোক কী বলল, তাতে কী এসে যায়!” আমার মনে হয়, ওঁর ফিল্মগুলো ফ্লপ করার একটা বড় কারণ হল, প্রোমোশনে বিশাল খরচ করা হত না। দেব অক্লান্তভাবে তা-ও ছবি বানিয়ে যেতেন। এক এক সময় মনে হয়, ফিল্ম মেকিংয়ে এমন নিরবচ্ছিন্ন জড়িত না থাকলে, ওঁর ব্রেন হয়তো আগেই ইনঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ত। ৮৮ বছর অবধি বাঁচতেনই না। আর একটা জিনিস লক্ষ করতাম, উনি কাজ করতেন খুব ইকনমিক মডেলে। শু্যটিং শেডিউল খুব টাইট থাকত। কখনও শু্যটিং বাতিল করতেন না। ছক করে রাখতেন, স্যাটেলাইট রাইটস্ থেকে এত পাবেন, ভিডিও রাইটস্ থেকে এত আসবে। সারেগামা থেকে এত টাকার রয়্যালটি আসবে। আমি নিজে স্টক মার্কেট নিয়ে বহু বছর কাজ করছি। লগ্নি ব্যাপারটা বুঝি। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট বুঝি। লোকে যেমন বলত, ওঁর ছবি বানিয়ে যাওয়াটা পাগলামি, আমার সেটা কখনও মনে হয়নি। বাজারে ওঁর এক টাকাও ঋণ নেই। উল্টে ছেলে সুনীল আনন্দ যা পেয়েছে, সেই সম্পত্তির বাজার মূল্য প্রায় তিনশ কোটি টাকা।
স্টাইল আইকন: দেব সাব প্রকৃত অর্থেই ছিলেন স্টাইলিশ মানুষ। শুধু দেশে নয়, বিদেশে গিয়েও সেরা জিনিসটাই বেছে নিতেন নিজের জন্য। আমেরিকাতেও দেখেছি সেরা শপিং মলটাতেই ওঁর যাওয়া চাই। যেটা সবচেয়ে ফ্যাশনেবল সেটাই ওঁর কেনা চাই। প্লেনে ট্র্যাভেলও করতেন ফার্স্ট ক্লাসে। স্টাইল বিপন্ন হতে পারে এমন কার্পণ্যের মধ্যে উনি কখনও যাননি। মেহবুব স্টুডিওতে আজও অত্যন্ত ফ্যাশনেবল কুড়িখানা বালি শু্যজ রাখা আছে ওঁর। আছে স্কার্ফ, জ্যাকেট আর টুপি। সবই ডিজাইনার আর বিদেশে শপিং করতে গিয়ে সংগ্রহ করা। মেয়েরা যে ঝপাঝপ ওঁর প্রেমে পড়ত, তাতে আর আশ্চর্য কী!
এভারগ্রিন মনোভাব: উনি চলে গিয়েছেন দেড় বছরেরও বেশি। কিন্তু আমার আজও মনে হয়, উনি চলে যাওয়ার পর বলিউড আর বলিউড নেই। এ রকম স্টার আর আসবেন না, যিনি এই বয়সে নিজের প্যাশনের পেছনে এমন প্রাণান্তকর দৌড়তে পারে। কোনও কোনও দিন এই বয়সে ওঁকে আমি আঠারো ঘণ্টাও কাজ করতে দেখেছি। কাজের প্যাশন যেন ওঁকে দিয়ে ম্যারাথন দৌড় করাত। অদ্ভুত মানুষ। কখনও মুখে খারাপ কথা শুনিনি। আজ মনে হয়, ঈশ্বরও কি মানুষ হিসাবে এত ভাল? সারা দিন কাজ করতেন। মনকে কখনও খালি রাখতেন না। বিয়েবাড়ি, অ্যাওয়ার্ড ফাংশন এগুলোতে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। অথচ এত কাজ করেও কখনও মুখ-চোখ দুর্বল মনে হত না। সব সময় যেন তারুণ্য ঝিকমিক করছে। এমন স্টার আর আসবেন না যিনি নিজের ফোন শেষ দিন অবধি নিজে ধরেছেন। এসএমএস করতে পারতেন না। ইনবক্স খোলার ব্যাপারেও সমস্যা ছিল। রোজ রাত্তিরে আমার কাজ ছিল, মোবাইল থেকে ফ্যানেদের মেসেজগুলো বার করে ওঁকে শোনানো। তার পর উনি উত্তর বললে, সেটা টেক্সট করা। এত মাটির কাছাকাছি আজকালকার স্টারেরা থাকেন বলে মনে হয় না। কিন্তু দেব সাব তাঁদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারেন। আমার কাছে উনি থেকে যাবেন একজন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ম্যান হিসাবে। যাঁর সব দিকগুলোই সমান মজবুত। |
|
‘গাইড’ ছবির একটি দৃশ্যে দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রহমান |
রোম্যান্সের স্টাইল: জীবনের শেষ দিন অবধি মহিলাদের কাছে তিনি সেই আকর্ষণীয় চুম্বক থেকেই গিয়েছিলেন। আমি যেহেতু এসএমএসগুলো পড়ে শোনাতাম তাই প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মেয়েরা ওঁকে কবিতা, গান লিখে প্রেম নিবেদন করত। দেব নিজেও ভীষণ রোম্যান্টিক ছিলেন। এখনকার নায়কদের মতো ওই বাইসেপস্ আর ট্রাইসেপস্ দেখানোটা ওঁর কাছে অসহ্য ছিল। মেয়েরা ওঁকে লিখত, কী সব গান আপনার লিপে! ‘ফুলো কে রং সে’, ‘আরে ইয়ার মেরি, তুমভি হো গজব, ঘুঙ্ঘট তো জারা ওরো’, ‘গাতা রহে মেরা দিল’। আজীবন নায়িকাদের সঙ্গে গাছের ডালে ঘুরে গান গেয়েছেন বলে ওঁর ইমেজারিটাও বোধ হয় এত বছর ছিল। ওঁর পুরোনো নায়িকারাও, কী মুমতাজ, কী নন্দা, কী বৈজয়ন্তিমালা শেষ দিন অবধি দেবের প্রতি একটা অদ্ভুত ভালবাসায় আচ্ছন্ন ছিলেন। দেব শুনে হাসতেন যে, মহিলাদের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য কত তরুণ তাঁকে হুবহু কপি করত। আমরা বলতাম কলারটা তোলো, গলায় স্কার্ফ জড়াও, মাথায় স্টাইলিশ টুপি পরো, একটু বেঁকে হাঁটো, আর তাড়াতাড়ি কথা বলো। ব্যস, দেব আনন্দ হয়ে গেলে। তোমার মহিলা ধপ করে পড়ে গেল।
ডিজাইনার বিতৃষ্ণা: ওঁর ছবিতে পুরুষ আর মহিলাদের ড্রেস দেব সাবই ডিজাইন করতেন। উনি মনে করতেন, নায়কেরা কিছু দিন কাজ করার পর নিজেদের মধ্যে উপলব্ধি আসা উচিত, কোন ড্রেস সে পরবে। কোনটায় তাকে বেশি মানাবে, কোনটায় মানাবে না। উনি বলতেন, “ডিজাইনারই যদি কমন মানুষকে হিরো বানিয়ে দিতে পারে, তা হলে ডিজাইনার নিজে কেন হিরো সাজছে না!”
প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ: গত পঁচিশ বছর ধরে আনন্দ পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। অথচ আমি ওঁর স্ত্রী মোনা সিংহকে কোনও দিন মিট করিনি। দেব সাবের বাড়িতে গিয়েও কখনও দেখা হয়নি। উনি বোধ হয় একেবারেই অন্তঃপুরবাসিনী। আমার দেখেটেখে মনে হয়েছে, দেব সাবের শাদি বোধ হয় কাজের সঙ্গেই আজীবনের জন্য হয়ে গিয়েছিল। আর প্রেম যদি বলেন সুরাইয়া বাদ দিয়ে দেব সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছিলেন জিনাত আমনের। আমার ধারণা চির রোম্যান্টিক দেব আনন্দের সেটাই শেষ প্রেম। জিনাতের নবকেতন ছেড়ে যাওয়াটা ওঁকে এত আঘাত দিয়েছিল যে, আত্মজীবনীতে পর্যন্ত লিখেছিলেন। জিনাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেব অনেক বার আনমনা হয়ে পড়েছেন। ওঁর কাছে জিনাতের আকর্ষণ ছিল স্টাইল। ইংরেজি ভাষার ওপর দখল। আর ব্যক্তিত্বের ধরনটা। কোথাও গিয়ে দু’জনের দর্শনে একই রকম পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল। শেষ দিকে আর জিনাতের সঙ্গে অনেক বছর দেখা হয়নি। কিন্তু মনের মধ্যে জায়গাটা থেকেই গিয়েছিল।
বচ্চন এবং খানেরা: অমিতাভ বচ্চনকে খুব পছন্দ করতেন দেব সাব। বলতেন জেনুইন ভদ্রলোক। যখনই দেবের কোনও কিছু নিয়ে আমরা অমিতাভকে টেক্সট করেছি, এক মিনিটের মধ্যে সে এসএমএসের অবধারিত জবাব এসেছে। ‘চার্জশিট’-এর প্রিমিয়ারের আগে আমরা যখন মিস্টার বচ্চনকে ডাকি, উনি এক কথায় হ্যাঁ করে দেন। তিন খানকেও দেখেছি দেব সাবের ব্যাপারে খুব শ্রদ্ধাশীল।
আর এক রোম্যান্টিক মহানায়ক রাজেশের সঙ্গে দ্বৈরথ: দ্বৈরথ বলতে সেই অর্থে কোনও তিক্ততা ছিল না। তবে রটনা যে ছিল, সেটা সত্যি কথা। আসলে ‘আরাধনা’ যখন রমরম করে চলছে, তখন আলি পিটার জন নামে এক বিখ্যাত সাংবাদিক এসে দেবকে বলেন, “কী! নতুন ছেলেটা তো সব নিয়ে চলে গেল!” দেব তখন হেসে বলেছিলেন, “২৫ বছর বাদে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসো।” আসলে উনি বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন, ক্ষণস্থায়ী একটা প্রভাব তৈরি করাই যায়। কিন্তু আসল মস্তানি হল স্টারডমকে অক্ষত রেখে দেওয়া। আজ মনে হয়, রাজেশের ব্যাপারে উনি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার দু’জনে এত বছর একসঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিতে, অথচ দেখাই প্রায় হয়নি। আমি বলব, দেব সাবের কোথাও না-যাওয়াটাই এর কারণ। ইন্ডাস্ট্রি একসঙ্গে জড়ো হয় হোলিতে। কিন্তু সেখানে রঙের চৌবাচ্চায় চানটানে দেব সাবের ঘোরতর আপত্তি ছিল। রাজেশ-দেব প্রথম দেখা হল, ২০০৮-এর গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আমিও সেখানে ছিলাম। সামান্য কথাবার্তার আদানপ্রদান হয়েছিল। পরের বছর পুণেতে অশোকা ফিল্মসের ১০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে দু’জনেই নিমন্ত্রিত ছিলেন। এই প্রথম স্টেজের ওপর দেখা হল রাজেশ খন্না আর দেব আনন্দের। বেশ সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করলেন দু’জন দু’জনের সঙ্গে। আর বরফটা পুরোপুরি কেটে গেল রাজেশের ভাষণের পর। রাজেশ বললেন, “লড়কিয়া মেরে লিয়ে পাগল হো যাতি থি। পর দেব সাব কে লিয়ে ও মর যাতি থি।” অর্থাৎ, রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে আবেদনের তীব্রতায় দেব এগিয়ে। মেয়েরা একজনের জন্য পাগল হত। আর একজনের ক্যারিশমায় মরে যেতেও রাজি ছিল। দেব শুনে বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। চিবুক নেড়ে দিলেন তিনি রাজেশের। পুণের মঞ্চে ভারতীয় ফিল্ম তারকা ইতিহাসের এক অসাধারণ মুহূর্ত তৈরি হল।
রোম্যান্সিং উইথ লাইফ: মাচো ম্যান বলতে যা বোঝায়, কখনওই তা ছিলেন না। কিন্তু অসম্ভব পজিটিভ থাকতেন। এড়িয়ে চলতেন নেগেটিভ মানুষদের। আমাদের গ্রুপ আলোচনায় তুমুল হতাশার মধ্যেও যখন কেউ কোনও পজিটিভ কথা বলত, উনি খুব অনুমোদনের ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বলতেন, “এই তো।” শিক্ষিত মানুষদের খুব পছন্দ করতেন। নিজে আত্মজীবনী লিখতে বসেছিলেন ৮১ বছর বয়সে। অত মোটা বইয়ের প্রত্যেকটা লাইন নিজের হাতে লেখা। সাত-আটটা মোটা মোটা খাতা ভরে গিয়েছিল। সকাল থেকে বসে ওই মঁ ব্লা পেনটায় লিখতেন। পাবলিশার আবার হাতে লেখা এত বড় বই নেবে না। সুতরাং ওটা কম্পোজ করার জন্য একজনকে ডাকা হয়েছিল। সে পুরোটা তোলার পর আবার তার সঙ্গে দেব সাব বসলেন। কোথায় কমা, কোথায় সেমিকোলন গণ্ডগোল হয়েছে, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটা লাইন দেখতেন। আমি কোনও দিন এক মিনিটও হাই তুলতে দেখিনি। বা বলতে শুনিনি এত মোটা বই সম্ভব নয়। জীবনের প্রতি ভালবাসার এত বড় প্রেমিক ছিলেন বলেই বোধহয় তাঁর প্রতি আমাদের প্রেমটা এমন অফুরান থেকে গেল। |
|
|
|
|
|