গর্জন যত করলেন, বর্ষণ তত হল না!
রাজ্যের শিল্প, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমালোচনা করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই
সেই সমালোচনার জবাব দিতে বসে পাল্টা যুক্তির বদলে বুদ্ধবাবুকে ব্যক্তিগত আক্রমণই করলেন রাজ্য সরকারের মুখপাত্র তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম।
শিল্পায়নে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে পাহাড়-জঙ্গলমহল, মেলা-উৎসবের সংস্কৃতি অনেক বিষয়েই রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেছিলেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু ফিরহাদ এ দিন শুধু বেছে নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততা নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তোলা প্রশ্নকে। পুরমন্ত্রী বলেন, “চোরের মুখে বড় গলা হয় না। ওঁকে বলতে হবে, যা বলেছেন তা অন্যায় ও পাপ। এমন এক জন মহিলার সম্পর্কে এ সব কথা বলছেন, যিনি সারা জীবন ত্যাগ ও সততায় উৎসর্গ করেছেন।” বুদ্ধবাবুর সততা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলে ফিরহাদের মন্তব্য, “উনি নিজে সৎ নন। এক জন জননেত্রী সম্পর্কে এ সব বলার নৈতিক অধিকার তাঁর কতটা রয়েছে?” প্রসঙ্গত দলের আইনজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দিন বুদ্ধবাবুকে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর। নোটিসে বলা হয়েছে, প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা না-করলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হবে। |
ফিরহাদ যুক্তির পথে না-হাঁটলেও আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে উত্তরবঙ্গের ফুলবাড়ি থেকে তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন রীতিমতো তথ্য দিয়ে বলেন, “ওঁদের আমলে মাত্র ৪৭০১টি শিল্প প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল। তার মধ্যে ৮৩৩টি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। সেগুলির মধ্যে ক’টার চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, তা আমরা দেখতে যাব। কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছিল, জমি কী ভাবে দেওয়া হয়েছিল তা-ও তদন্ত করে দেখব।” বুদ্ধবাবুর আমলে জমি বণ্টন নীতি ছিল না বলে শিল্পমন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য, “ওঁদের আমলে একটাই নীতি ছিল: এসো ভাই জমি লুট করে যাই/ শিল্পকে কলা দেখাই।” তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “দলে সমন্বয় থাকলে ববির মুখ খোলার দরকার হত না। পার্থর দেওয়া তথ্য নিয়েই মহাকরণ থেকে সরকারি ভাবে বুদ্ধবাবুর সমালোচনার মোকাবিলা করা যেত!”
দলীয় রাজনীতির বিষয় নিয়ে মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলন করতে কসুর করেন না মুখ্যমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী কেউই। অথচ বুদ্ধবাবু সরকারের যে সমালোচনা করেছেন, তার জবাব দেওয়ার জন্য মহাকরণকে বাছেনি তৃণমূল। সাংবাদিকদের ডাকা হয় তৃণমূল ভবনে। এগিয়ে দেওয়া হয় মমতা-ঘনিষ্ঠ ফিরহাদকে। যিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তোলা অভিযোগের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেননি। রাজনীতির কারবারিরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাকে পাত্তা না-দিয়ে ফিরহাদের মন্তব্য, “রাজ্যের মানুষ যাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, যাদবপুরের মানুষ যাঁকে বিধায়ক হিসেবে ত্যাগ করেছেন, তাঁর মানসিক ভারসাম্য কতটা আছে, তা প্রশ্নের বিষয়। পরিত্যক্ত এই ভদ্রলোক কী বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না।”
বুদ্ধবাবুকে আমল না-দেওয়ার কথা বললেও ঠিক তার পরেই তাঁর আমলে তাপসী মালিক হত্যা, নন্দীগ্রাম-নেতাই কাণ্ডের উল্লেখ করে ফিরহাদের কটাক্ষ, “যাঁর সারা জীবনটাই শূন্য, যিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বনাশ করেছেন, একটাও সুনির্দিষ্ট শিল্পের কথা উল্লেখ করতে পারবেন না, তার থেকে বড় অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী আর কে!” মঙ্গলবার একটি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দশে শূন্য দেন বুদ্ধবাবু। ফিরহাদের মন্তব্য, “যিনি নিজে শূন্য, তিনি অন্যকে নম্বর দিয়ে মূল্যায়ন করতে পারেন না।”
ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের সম্পত্তি বৃদ্ধি নিয়ে তদন্ত প্রয়োজন বলে বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ফিরহাদের প্রতিক্রিয়া, “কার কতটা সম্পত্তি আছে, তদন্ত হতেই পারে। কিন্তু বলব, তৃণমূল একমাত্র স্বচ্ছ দল। আমরা নিজেরা স্বচ্ছ। বুদ্ধবাবু নীতিগত ভাবে কতটা স্বচ্ছ, সেটাই প্রশ্নের।” সিপিএম নেতারা কত টাকার চশমা পরেন প্রশ্ন তুলে পুরমন্ত্রী বলেন, “আমার হাতে আয়কর দফতর থাকলে তদন্ত করাতাম।”
ফিরহাদের আক্রমণ অবশ্য সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছেন বুদ্ধবাবু। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “উনি কী বলছেন, তা নিয়ে আমি কোনও পাল্টা মন্তব্য করব না। আমি আমার কথা বলেছি। যা বলেছি, সবাই তা দেখেছেন। পাল্টা কিছু বলার নেই।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, “আমি ফিরহাদের কথার কোনও জবাব দেব
না। যদি মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলতেন, সে ক্ষেত্রে বলার কথা ভাবতাম।” এ দিন মানিকতলার দলীয় সভায় সরকারের নানা ব্যর্থতা নিয়ে সরব হন সূর্যবাবু। আর সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ববিকে বলার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই তৃণমূল অফিসে গিয়ে ওঁকে বলতে হয়েছে। কিন্তু ববি নিজেও জানেন, কৃষি, শিল্প থেকে আরম্ভ করে জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে বুদ্ধদা যা বলেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে ওঁর কিছুই বলার নেই!”
গৌতমবাবু আরও বলেন, “আমরা শুধু সমালোচনা করতে চাই না। শিল্প ও উন্নয়নের কাজে মুখ্যমন্ত্রীকে সাহায্য করতে চাই। এটা শুধু সরকারের সমালোচনা ও পাল্টা জবাবের বিষয় নয়। রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়। সে ক্ষেত্রে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা করে চলতে পারলে রাজ্যের ভাল হবে। মুখ্যমন্ত্রীকেও বুঝতে হবে, তাঁর নিজস্ব জমি নীতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে রাজ্যে শিল্প হবে না।” মমতা-সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরীও। এ দিন শ্যাওড়াফুলিতে রেলের এক অনুষ্ঠানে অধীর বলেন, “অসহিষ্ণুতা ও দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে মমতা বেশি দিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না। রাজনৈতিক বাস্তবতা যদি সত্য হয়, কংগ্রেস রাজ্যে দায়িত্ব নেবে।” অধীরের মন্তব্যকে অবশ্য কোনও গুরুত্ব না দিয়ে পার্থবাবুর পাল্টা মন্তব্য, “অধীরবাবু আগে মুর্শিদাবাদ সামলান, তার পরে রাজ্যের কথা ভাববেন। আর কংগ্রেস? পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস তো জেলা কংগ্রেসে পরিণত হয়েছে! ওঁরা কী করবেন!” |