|
|
|
|
একশো দিনের কাজে গুচ্ছ অনিয়ম পশ্চিমে |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
একশো দিনের কাজের প্রকল্প নিয়ে বহু অভিযোগ ওঠে। অভিযোগগুলো যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, এ বার তারই প্রমাণ মিলল রাজ্য স্তরের এক মনিটরিং রিপোর্টে। যা থেকে স্পষ্ট, রাজ্য সরকার যতই প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে প্রচার করুক, আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বহু অস্বচ্ছতা, কারচুপি, দুর্নীতি।
একশো দিনের কাজের প্রকল্পের হাল খতিয়ে দেখতে সমীক্ষায় নেমেছে রাজ্য সরকার। ডিসেম্বর মাস থেকে সমীক্ষা শুরু হয়েছে। সেই মতো পশ্চিম মেদিনীপুরের ৬টি ব্লকের ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে এসে সরেজমিনে কাজের পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন প্রকল্পের স্টেট লেভেল মনিটর সুশীলকুমার পাল। পরিদর্শন শেষে তিনি জেলা প্রশাসনের কাছে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, সেখানে বিভিন্ন অনিয়মের উল্লেখ রয়েছে। রিপোর্টে পঞ্চায়েতের এক জব অ্যাসিস্ট্যান্টকে বদলির পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, চন্দ্রশেখর পাণিগ্রাহী নামে ওই জব অ্যাসিস্ট্যান্ট কেশিয়াড়ি ব্লকের কুসুমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে কর্মরত। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই পঞ্চায়েতে রয়েছেন। দীর্ঘ দিন একই জায়গায় থাকার ফলে প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে তিনিই ‘শেষ কথা’ বলেন। পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ তাঁর কথায় সিলমোহর দেন। শুধু বদলির পরামর্শই নয়, ওই পঞ্চায়েত কর্মীর কাজকর্ম নিয়ে তদন্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একশো দিনের প্রকল্পের জেলা নোডাল অফিসার প্রিয়াঞ্জন দাস বলেন, “বদলির বিষয়টি পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরকে জানাচ্ছি।” |
অনিয়মের সাত-কাহন |
• খরচ দেখাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প।
• আলোচনা না করেই প্রকল্প চূড়ান্ত।
• অনুমোদন না নিয়ে সরঞ্জাম ক্রয়।
• পড়ে থেকে সরঞ্জামের অপচয়।
• মাস্টার রোলে প্রচুর গরমিল।
• সোশ্যাল অডিট হয়নি।
• ব্লক থেকে নজদরদারি নেই। |
|
সুশীলবাবু ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত জেলার ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে গিয়ে কাজের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো হল দাঁতন ১ ব্লকের তররুই, কেশিয়াড়ির কুসুমপুর, গড়বেতা ২-এর (গোয়ালতোড়) পাথরপাড়া, সাঁকরাইলের ছত্রি, ঝাড়গ্রামের সাপধরা এবং দাসপুর ২-এর গৌড়া ৩। পঞ্চায়েতগুলিতে একশো দিনের প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন সুশীলবাবু।
রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছে, তররুই গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে গত তিন মাসে শেষ কবে এই এলাকায় এসেছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম অফিসার, তা প্রধান এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মীকেউই বলতে পারেননি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। বলা হয়েছে, মাস্টার রোলে থাকা সইয়ের সঙ্গে একাংশ শ্রমিকের সই মেলেনি। ফলে, ওই শ্রমিকেরা কাজ পেয়েছেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না। মনিটর নিজে দু’টি প্রকল্প পরিদর্শন করেন। দু’টি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই অস্বচ্ছতা খুঁজে পান। এমন একটি মোরাম রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে আগে থেকেই মোরাম রাস্তা রয়েছে।
কুসুমপুরের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এমন একটি পুকুর খনন করা হয়েছে, যেখানে আগে থেকে পুকুর ছিল। প্রকল্পের পরিকল্পনা হয় ২০০৯-১০ সালে, চূড়ান্ত হয় ’১০-’১১ সালে এবং রূপায়িত হয় ’১২-’১৩ সালে। যখন প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছিল, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা। অথচ, খরচ হয়েছে ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯৪৭ টাকা। পরে কাজ শুরু হলে খরচ বাড়ার কথা, এ ক্ষেত্রে খরচ কমেছে। প্রধানের যুক্তি, পাথুরে এলাকা বলে পরিকল্পনা মতো পুকুর খনন হয়নি। অথচ, সুশীলবাবুর এলাকাটি পাথুরে বলে মনে হয়নি।
পাথরপাড়ার ক্ষেত্রে মাস্টার রোলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ছত্রির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সময় মতো সংসদ বৈঠক হয়নি। মাস্টার রোলেও অসঙ্গতি রয়েছে। সাপধরার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মাস্টার রোল থেকে দেখা যাচ্ছে, এই এলাকারই দু’জন ৭ দিন করে কাজ পেয়েছেন। তবে তাঁদের জব কার্ড তা বলছে না। পুকুর খনন প্রকল্পের কাগজপত্রেও অসঙ্গতি রয়েছে। অন্য দিকে, গৌড়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ’১২-’১৩ আর্থিক বছরে কোনও সোশ্যাল অডিট হয়নি। এই অডিটের জন্য পদক্ষেপ না-করা পর্যন্ত এই গ্রাম পঞ্চায়েতকে একশো দিনের প্রকল্পে আর অর্থ না-দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
একশো দিনের প্রকল্পে কাজের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জেলা স্তরের এক বিশেষ দলও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে পরিদর্শন করেছে। সেই ‘ডিস্ট্রিক্ট লেভেল টিম’-এর ২৯টি ব্লকের মোট ২৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে পরিদর্শন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। তার মধ্যেই স্টেট লেভেল মনিটরের এই রিপোর্টে বিড়ম্বনায় পড়েছে খোদ প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “রিপোর্টে যে সব অস্বচ্ছতা এবং গাফিলতির উল্লেখ রয়েছে, তা গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। বলা হয়েছে, ব্লকস্তর থেকে নজরদারির অভাব রয়েছে। সেই নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম অফিসারদেরও সময় মতো প্রকল্প পরিদর্শন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
প্রশাসনের এই পদক্ষেপের ফলে প্রকল্পের সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অস্বচ্ছতা, কারচুপি এবং দুর্নীতিগুলো দূর হয় কি না, সেটাই এখন দেখার। |
|
|
|
|
|