|
|
|
|
বিদ্যুৎমন্ত্রীর সেই হলফনামায় অস্বস্তিতে সরকার |
দুষ্কৃতীরাই গুলি চালায়, রিপোর্ট দিয়েছিলেন মণীশ |
শমীক ঘোষ |
তখন ছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব। এখন রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী। কুড়ি বছর আগেকার ২১ জুলাই নিয়ে সম্প্রতি যখন বিতর্ক তুঙ্গে, গুলিচালনার দায়ে তৎকালীন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা, তখন আর এক বার সামনে এল সেই সময় হাইকোর্টে জমা দেওয়া মণীশ গুপ্তের হলফনামাটি। যে হলফনামায় যুব কংগ্রেসের ওই সমাবেশে বহু সশস্ত্র ও নেশাগ্রস্ত সমাজবিরোধীর জমায়েতের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারাই পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা, গুলি ছোড়ে। এই ঘটনায় বহু পুলিশ এবং সাধারণ নাগরিকও জখম হন।
১৯৯৩ সালের ২ অগস্ট হাইকোর্টে এই হলফনামাটি জমা দিয়েছিলেন মণীশবাবু। রিপোর্টটি তৈরি করে দেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার। ২১ জুলাই নিয়ে বিচারবিভাগীয় কমিশনের কাছে বুধবার ওই হলফনামার প্রতিলিপি পেশ করেন মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে ২১ জুলাইয়ের পুলিশি গুলিচালনার ঘটনার তদন্তে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় ওই কমিশনের চেয়ারম্যান। মাস তিনেক হল ওই কমিশনে শুনানি শুরু হয়েছে। সোমবার কমিশনে হাজির হয়ে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র গুলিচালনার জন্য সরাসরি বুদ্ধবাবুকে দায়ী করেছিলেন। মঙ্গলবার টিভি সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেববাবু সেই অভিযোগ নস্যাৎ করে বলেছিলেন, “এ সব মহাকরণ থেকে কেউ পুলিশকে নির্দেশ দেয় নাকি? ওখানে গোলমাল ঘটাল। একটু পরে শুনলাম ওখানে গুলি চলেছে।” এ দিন সুজাত ভদ্রের জমা দেওয়া রিপোর্ট তদন্ত কমিশনের শুনানিতে নতুন মাত্রা যোগ করল। ঘোরতর অস্বস্তিতে পড়ল রাজ্য সরকার।
মণীশবাবুর সেই রিপোর্টে আর কী বলা হয়েছিল?
হাইকোর্টে জমা দেওয়া সেই হলফনামায় বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সারা রাজ্যের কয়েক হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, রাণি রাসমণি অ্যাভিনিউ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং ব্রেবোর্ন রোডে জমায়েত হয়। মেয়ো রোডে ১৫ হাজার, ধর্মতলায় ১৫ হাজার, ব্রেবোর্ন রোডে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১০ হাজার, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে ৭ হাজার জমায়েত। জমায়েতে বহু সশস্ত্র সমাজবিরোধী নেশাগ্রস্ত অবস্থায়
জড়ো হয়েছিল।
রিপোর্টের প্রতিলিপি অনুযায়ী, পুলিশ পাঁচ জায়গাতেই শক্তিশালী কর্ডন করে রাখে। প্রতিটি জায়গায় সমাবেশকারীরা প্রথম থেকেই কর্ডন ভেঙে মহাকরণের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। যদিও আগাগোড়া নেতারা বলেছিলেন, জমায়েত হবে শান্তিপূর্ণ, কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশের উপর হামলা চালানোর জন্য নেতারা জ্বালাময়ী ও উত্তেজক বক্তৃতা দেন। মহাকরণের দিকে ধেয়ে গিয়ে তা দখল করতেও প্ররোচনা দেন। যুব কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ছিল, তারাই যে সব থেকে সক্রিয়, জনপ্রিয় এবং জঙ্গি তার প্রমাণ দেওয়া।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেলা ১১টা নাগাদ হাজরা থেকে বড় মিছিল নিয়ে মদন মিত্র এবং পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়ো রোডে পৌঁছন এবং পুলিশের কর্ডন ভেঙে মহাকরণের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন। মমতা মেয়ো রোড ও রেড রোডের সংযোগস্থলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই পৌঁছন এবং বলেন, পুলিশ তাঁকে সেখানে সভা করতে দেবে না। তিনিও কর্মীদের কর্ডন ভেঙে মহাকরণের দিকে যেতে বলেন। কিছু ক্ষণ পরে অবশ্য মমতা সেখান থেকে চলে যান। যাওয়ার আগে বলে যান, খানিক পরেই তিনি ফিরে আসবেন।
রিপোর্ট বলছে, গোলমালের শুরুতেই কয়েক জন নেতা দৌড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালান। ফলে জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক কমে যায়। বাঁধনছাড়া জনতা ব্যাপক গোলমাল পাকাতে থাকে। নেতারা জনতাকে ফেলে মমতার সঙ্গ নেন। মমতা তখন হাঁটতে শুরু করেছেন। ওই সময় ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়। মহাকরণের দিকে যুব কংগ্রেস কর্মীরা ছুটতে থাকেন। পুলিশ প্রথমে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জনতাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়। জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে পাইপগান থেকে গুলি ছোড়ে। ইট, পাথর, সোডার বোতলও ছোড়ে। পুলিশ তখন লাঠিচার্জ করে, ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় এবং রাইফেল থেকে ৭৫ রাউন্ড ও রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে ১২ জন মারা যান বলে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও গুলিবিদ্ধ হন ৯ জন। |
|
কে কী ভাবে গুলিচালনা শুরু করেন? রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও মেয়ো রোড, রেড রোড, ডালহৌসি রেঞ্জার্স গ্রাউন্ড এলাকার উন্মত্ত জনতাকে থামানো যাচ্ছিল না। এক সময় পুলিশকে ঘিরে ফেলে তারা। তাণ্ডবে আহত হন ১৬ জন পুলিশ, যে দলে রয়েছেন যুগ্ম কমিশনার, ডিসি এসডি প্রমুখ। শেষে নিজেদের প্রাণ ও সরকারি সম্পত্তি বাঁচাতে বাধ্য হয়েই রিভলভার থেকে গুলিচালনার নির্দেশ দেন যুগ্ম কমিশনার। সেই দফায় ৮ রাউন্ড গুলি চলে। এর পরে মেয়ো রোডে সাউথ ট্র্যাফিক গার্ডের সার্জেন্ট ই ডে চার্লসকে ঘিরে ধরে উন্মত্ত জনতা। তিনি প্রাণ বাঁচাতে তাঁর রিভলভার থেকে দু’রাউন্ড গুলি ছোড়েন।
ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ওই রিপোর্ট জানাচ্ছে, জনতা তিনটি বাসে আগুন লাগায়। ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে। সব মিলিয়ে জখম হন ২১৫ জনেরও বেশি পুলিশ। তাঁদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিসি (সদর), সাত জন ডিসি, ১০ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রয়েছে। ৩৪ জন পুলিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেরই পাইপগানের গুলি এবং বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল।
সুজাতবাবুর দৌলতে এই রিপোর্ট সামনে আসায় রীতিমতো অস্বস্তিতে সরকার তথা শাসকদল তৃণমূল। বর্তমান বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে এড়িয়ে যান। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বললেন, “মণীশ গুপ্ত তৎকালীন সিপিএম সরকারের চাকরি করতেন। তাই সিপিএম সরকারের তৈরি করে দেওয়া হলফনামাই তিনি হাইকোর্টে জমা দিয়েছিলেন। ওই দিন কোনও পুলিশ যে জখম হয়েছিলেন, এমন কোনও তথ্য কখনও সামনে আসেনি। এমনকী, বিধানসভাতেও প্রশ্নের উত্তরে সিপিএম সরকারই জানিয়েছিল, ২১ জুলাইয়ের ঘটনায় এক জনও পুলিশ জখম হননি।”
মদনবাবুর সুরেই একটি মহল বলছে, ওই রিপোর্ট তো তৎকালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের। মণীশবাবু শুধু রিপোর্টটি হাইকোর্টে পেশ করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটি মহল বলছে, মণীশবাবু স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন। তাই পুলিশকর্তাই তাঁকে রিপোর্ট তৈরি করে দেবেন। সেই রিপোর্টের দায়িত্ব তিনি কোনও ভাবেই এড়াতে পারেন না।
বস্তুত, মণীশবাবুকে মমতা যখন প্রার্থী করেন, তখনও এই প্রসঙ্গটি উঠেছিল। বলা হয়েছিল, যিনি স্বরাষ্ট্রসচিব থাকাকালীন ২১ জুলাইয়ের ঘটনা ঘটেছে, তাঁকে মমতা প্রার্থী করলেন কী ভাবে! তুষারবাবুর সঙ্গে এ দিন কথা বলা যায়নি। তাঁর বাড়ি থেকে জানানো হয়, তুষারবাবু অসুস্থ। সবে নার্সিং হোম থেকে ফিরেছেন। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
হাইকোর্ট এ দিন সুজাতবাবুর কাছে জানতে চান, তিনি এই রিপোর্ট কোথায় পেলেন? সুজাতবাবু জানান, গুলি চালানোর ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়ে তিনি সেই সময় হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তখন আদালতের নির্দেশে মণীশবাবু হলফনামাটি জমা দেন। এ দিন কমিশনে সেই রিপোর্টের প্রতিলিপিই জমা দেন তিনি।
|
একুশে জুলাইয়ের রিপোর্ট |
• জমায়েত ছিল মেয়ো রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, ধর্মতলা, ব্রেবোর্ন রোডে
• সশস্ত্র সমাজবিরোধীরা নেশা করে ভিড়ে মিশে ছিল
• দুষ্কৃতীর বোমা, গুলি, ইটে জখম ২১৫ পুলিশ, ২৫০ নাগরিক
• ৩টি বাসে আগুন, ভাঙচুর ৩৫টি গাড়ি ও একাধিক দোকান
• রাইফেল থেকে ৭৫, রিভলভার থেকে ৪৬ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ
• ছোড়া হয় ৩৪১ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসও
• ঘটনায় মৃত্যু ১২ জনের, গুলির জখম নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৯
• ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার:
১৭টি বোমা, ২টি করে তলোয়ার ও
ভোজালি, ১টি করে পাইপগান, চপার, ড্যাগার। |
১৯৯৩ সালের ২ অগস্ট হাইকোর্টে পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের
তৈরি রিপোর্টটি জমা দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্ত |
|
|
|
|
|
|