|
|
|
|
|
|
বন্ড বৃত্তান্ত |
রিটার্ন ভাল। কিন্তু ঝুঁকি কম। সুদ আকর্ষণীয়। অথচ লগ্নি সুরক্ষিত।
এমন
প্রকল্পের খোঁজ করলে, বন্ড বাজারে ঢুঁ মারুন।
পরামর্শ দিলেন প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী |
সঞ্চয় নিয়ে আলোচনায় চার মাথা এক হলেই, শেয়ার নিয়ে বিস্তর কথা বলি আমরা। ঝুঁকি সত্ত্বেও চড়া রিটার্নের আশায় উঁকি দিই স্টক এক্সচেঞ্জের দরজায়। দাম আকাশছোঁয়া হলেও সুযোগ খুঁজি সোনায় লগ্নির। অথচ তুলনায় অনেক কম ঝুঁকির হওয়া সত্ত্বেও বন্ড যেন কিছুটা দুয়োরানি। অন্তত সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার কিংবা পরিচিতির নিরিখে তা এখনও শেয়ার কিংবা সোনার তুলনায় বহু যোজন পিছনে। কিন্তু যাঁরা ঝুঁকির আগুনে হাত না পুড়িয়েও ভাল রিটার্ন পেতে আগ্রহী, বন্ডের বাজার হয়তো তাঁদের নিরাশ করবে না।
সব মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, মানসিকতা কিংবা পরিস্থিতি তো সমান নয়। বয়স, সাংসারিক দায়, আর্থিক ক্ষমতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে শেয়ার বাজার বা সোনায় লগ্নি করা আপনার পক্ষে অসুবিধাজনক হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে রিটার্নের কড়ি ঘরে তুলতে বন্ড বাজার আপনার অন্যতম বাজি।
|
বন্ড কী? |
বন্ড হল এক ধরনের ঋণপত্র। সরকার, সরকারি সংস্থা কিংবা বেসরকারি সংস্থা যে কেউই তা ইস্যু করতে পারে।
তার মানে, আপনি যখন বন্ড কেনেন, তখন আসলে সেই লগ্নিকৃত অর্থ ঋণ হিসেবে দেন কোনও সরকার বা সংস্থাকে। যার বিনিময়ে আপনাকে সুদ (বন্ডে যার নাম ‘কুপন রেট’) দেয় তারা। সুতরাং, যিনি বন্ড কিনছেন, তিনি হলেন ঋণদাতা। আর যে সংস্থা বা সরকার বন্ড বাজারে ছাড়ছে, সে আসলে ঋণগ্রহীতা।
|
ধার দিলেও ‘মালিক’ নন |
কোনও সংস্থার শেয়ার কেনার মানে, আপনি অন্তত খাতায়-কলমে তার আংশিক মালিক হিসেবে গণ্য হবেন। শেয়ারের কোনও মেয়াদ নেই। তাই যত দিন তা না বেচে হাতে রাখবেন, তত দিন সেই ‘মালিকানা’ ভোগও করতে পারবেন আপনি।
বন্ডের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। অধিকাংশ বন্ডেরই নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। তাই যত দিন তা আপনার কাছে, তত দিন সেই বাবদ সুদ পাবেন। মেয়াদ শেষে ফেরত পাবেন আসলও। কিন্তু ব্যাস্। ওইখানেই সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কে দাঁড়ি।
|
|
ঝুঁকি অনেক কম |
শেয়ারের থেকে আপনি কতটা ডিভিডেন্ড পাবেন, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার মুনাফার উপর। কারণ, সংস্থা লাভ করলে, তবেই তো তার ভাগ (‘শেয়ার’) পাবেন আপনি।
কিন্তু বন্ডে সেই ঝুঁকি নেই। কারণ, এখানে অধিকাংশ ঋণপত্র ছাড়ার সময়েই নির্দিষ্ট সুদের হার ঘোষণা করতে হয়। দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া পুরো মেয়াদেই যার হেরফের করা সম্ভব হয় না। ফলে, সংস্থার লোকসান কিংবা সরকারের ঘাটতি হলেও, সুদ আপনার বাঁধা।
শুধু তা-ই নয়। কোনও কারণে সংস্থা উঠে গেলেও, আইনের চোখে পাওনাদার হিসেবে অগ্রাধিকার কিন্তু বন্ডের মালিকেরই। তাই সে ক্ষেত্রে সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে আগে তাঁদের টাকা মেটাতে হবে। সব শেষে টাকা পাবেন শেয়ারহোল্ডাররা।
|
তা বলে ঝুঁকি শূন্য নয় |
বন্ডে সুদের হার নির্দিষ্ট। তা বলে ঝুঁকি যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। কারণ, বন্ডের বাজার দর সাধারণত ব্যাঙ্ক সুদের উল্টো দিকে হাঁটে। ব্যাঙ্ক-জমায় সুদ কমলে, বন্ডের দর বাড়ে। আর সুদ বাড়লে, বন্ডের দাম কমে। ফলে, সেকেন্ডারি মার্কেটে হাতে থাকা বন্ডের দর কমার ঝুঁকি বইতেই হবে।
কিন্তু এমনটা হয় কেন?
ধরুন, বন্ড আর ব্যাঙ্ক, দু’জায়গাতেই সুদ এখন ৯%। আপনি ১০০০ টাকা দামের বন্ড কিনলেন। এ বার ব্যাঙ্কে সুদ কমে হল ৮%। তখনও কিন্তু বন্ডে ৯ শতাংশই সুদ পাবেন আপনি। ফলে এক বছর তা ধরে রাখলে বাড়তি ১০ টাকা আসবে আপনার পকেটে। সুতরাং এই সময়ে আরও কিছুটা বেশি দামে (ধরা যাক, ১০৮৯ টাকা পর্যন্ত) এমন আর এক খানা বন্ড কিনলেও আখেরে আপনারই লাভ। এই কারণেই সুদ কমলে, বন্ডের চাহিদা ও দর বাড়ে। আর সুদ বাড়লে, উল্টোটা। তাই বন্ডে বিনিয়োগ করলে, সুদের ওঠা-পড়ার সঙ্গে তাল মেলাতে তৈরি থাকতে হবে আপনাকে।
তবে মনে রাখবেন, হাতফেরতা বন্ডের বাজারে (সেকেন্ডারি মার্কেট) ঋণপত্রের দাম পড়ে গেলেও, মেয়াদ ফুরনো পর্যন্ত লগ্নিকারী তা ধরে রাখলে, সংস্থা বা সরকারের কাছে পুরো টাকাই ফেরত পাবেন তিনি।
|
সুদ ফেস ভ্যালু-তে |
মনে রাখবেন, বন্ডের দর যা-ই হোক, সুদ দেওয়া হয় ফেস ভ্যালুর উপর। যেমন, ৯% সুদযুক্ত হাজার টাকা দামের বন্ড যদি ১১০০ টাকাতে কেনেন, তা হলেও বছরে সুদ কিন্তু সেই ৯০ টাকা। মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত বন্ড ধরে রাখলেও ফেরত পাবেন ১০০০ টাকা। ১১০০ টাকা নয়।
|
বন্ডের রকমফের |
• কর্পোরেট বন্ড: ইস্যু করে রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা বেসরকারি সংস্থা।
• সরকারি বন্ড: বাজারে ছাড়ে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার। • করমুক্ত বন্ড: প্রাপ্ত সুদের উপর কর দিতে হয় না। কর কাটা হয় না উৎসেও (টিডিএস)। গত বছর মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার এই বন্ড ইস্যু করেছে ফিনান্স কর্প, ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি, রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কর্প, হাডকো এবং রেলওয়ে ফিনান্স কর্প। তা ছাড়া, ৬০ হাজার কোটি টাকার করমুক্ত বন্ড ইস্যুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে গত বাজেটেও।
• কনভার্টিবল্ বন্ড: আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে ইক্যুইটিতে রূপান্তরযোগ্য। সাধারণ নিয়মে মেয়াদ ফুরোলে বিনিয়োগের টাকা ফেরত পান লগ্নিকারী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাবেন না। কারণ, তা নির্দিষ্ট সময় পর বদলে যাবে শেয়ারে। তখন আর সুদ পাওয়া যাবে না। বরং সংস্থা মুনাফা করলে, ডিভিডেন্ডের হকদার হবেন আপনি। তা বিক্রি করতে হলে, শেয়ার হিসেবেই বাজারে বিক্রি করতে হবে তাকে।
• কিউমুলেটিভ বন্ড: সাধারণত বছর ঘুরলেই (কিছু ক্ষেত্রে তিন বা ছ’মাস অন্তর) বন্ডের সুদ দেওয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হবে না। বরং মেয়াদ শেষে অনেকটা ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটের মতো চক্রবৃদ্ধি সুদ-সহ একবারে সবটা হাতে পাবেন আপনি।
• মূলধনী বন্ড: অন্য নাম সেকশন ৫৪-ইসি বন্ড। মূলধনী সম্পদ (বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি) হস্তান্তরে লাভের টাকা ছ’মাসের মধ্যে এখানে লগ্নি করলে, মূলধনী লাভ কর (ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স) থেকে রেহাই মেলে। লক-ইন মেয়াদ ৩ বছর। সুদ করযোগ্য। তবে উৎসে কর কাটা হয় না। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি এবং রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কর্প এটি ইস্যু করে।
|
কিনবেন কী ভাবে? |
শেয়ারের মতো বন্ড কেনা-বেচারও প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। বন্ডেও পাবলিক ইস্যু হয়। অর্থাৎ, কোনও সরকার বা সংস্থা বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন বন্ড বাজারে ছাড়ে। তা ছাড়া, স্টক এক্সচেঞ্জে যেমন পুরনো শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তেমনই হাতফেরতা বন্ডের ক্ষেত্রে তা হয় ঋণপত্রের সেকেন্ডারি মার্কেটে।
|
ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট কি বাধ্যতামূলক? |
অনেকেই প্রশ্ন করেন, নতুন বন্ড কেনার জন্য ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতমূলক কি না। উত্তর হল না। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বন্ড কিনতে হলে, এই অ্যাকাউন্ট থাকতেই হবে। তাই আমার মতে, প্রথম থেকেই ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে নেওয়া ভাল। কারণ, নতুন বন্ড কিনে শেয়ার বাজারের মাধ্যমে তা বেচতে গেলেও ওই অ্যাকাউন্ট খুলতেই হবে আপনাকে।
|
মেয়াদ কত দিনের? |
সাধারণত বন্ড দীর্ঘ মেয়াদের হয়। এমনকী তা হতে পারে ৫০ বছর পর্যন্ত। বিভিন্ন সরকার ও সংস্থা নানা মেয়াদের বন্ড ছাড়ে। তবে কিছু বন্ড আছে, যার মেয়াদ নির্দিষ্ট নয়। একে ‘পারপিচুয়াল বন্ড’ বলে। এই ঋণপত্রের ক্ষেত্রে অবশ্য নির্দিষ্ট সময় পর পর সুদ বদলায়।
|
ব্যাঙ্ক ছেড়ে বন্ডে কেন? |
অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, ব্যাঙ্কের সুরক্ষিত আমানত ছেড়ে বন্ডে টাকা রাখব কেন? আমার মতে, দু’জায়গারই নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তবে বন্ডের সুবিধা খুঁজতে গেলে, একটা কথা মাথায় রাখতে পারেন। তা হল মেয়াদ ফুরনোর আগেই হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলে, হাতে থাকা বন্ড বেচে দিতে পারেন আপনি। তাতে সুদের কোনও হেরফের হবে না। ব্যাঙ্কে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের আগে আমানত ভাঙাতে চাইলে, সুদের ব্যাপারে আপস করতে হবে আপনাকে। পুরো মেয়াদের জন্য নির্ধারিত সুদ সে ক্ষেত্রে আপনি পাবেন না। মেনে নিতে হবে অপেক্ষাকৃত
কম সুদই।
তা ছাড়া, ব্যাঙ্কের তুলনায় বাড়তি ঝুঁকি বইতে হলে, তার মূল্য হিসেবে বন্ডও নিশ্চয়ই তুলনায় কিছুটা বেশি সুদ দেওয়ার চেষ্টা করবে আপনাকে।
|
কেন লগ্নি? |
• আকর্ষণীয় সুদ |
• সরকারি বন্ডে উঁচু দরের সুরক্ষা |
• কোনও কোনও ক্ষেত্রে করছাড়ের সুবিধা |
• বাড়তে পারে নথিবদ্ধ বন্ডের দর |
• ফেস ভ্যালুর তুলনায় কম দামে (ডিসকাউন্ট) কেনার সুযোগ।
কিনতে পারলে, প্রকৃত আয় ছাপিয়ে যাবে ঘোষিত সুদকেও |
কিনবেন কী দেখে? |
• সংস্থার সুনাম, নির্ভরযোগ্যতা ও অতীত সাফল্য |
• বন্ডের ক্রেডিট রেটিং। ‘এএএ’ হলে ভাল। এএ+ হলেও
চলতে পারে |
• সুদের হার বাজারের তুলনায় বেশি কি না |
• মেয়াদ কত? আগে ভাঙানোর সুবিধা কেমন |
• করের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা মিলবে কি? |
• আগে বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যু করে থাকলে, সময়ে টাকা
মেটানোর নজির কেমন |
• সেবি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কি না |
• সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কোম্পানি বিষয়ক দফতরের
নিয়ম-কানুন বাজারে বন্ড ছাড়া সংস্থাটি মানছে তো? |
|
|
|
|
|
|