|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১ |
সুখে থাকা একা মেয়ে |
কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বা বাধ্য হয়ে। ঝক্কি কম নয়, তবু তাতেও আনন্দ খুঁজে নিয়ে
ওঁরা পা ফেলেন সাবধানী জীবনে। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
সিসিলি শহরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। মালেনার স্বামী আর্মি অফিসার নিনো স্কর্ডিয়া সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছেন। অতএব, মালেনা এখন তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকেন। তাতিয়ে দেওয়া সুন্দরী-তরুণী, তায় একদম একা! কারণ-অকারণে পাড়ার মধ্যবয়স্ক লোক থেকে শুরু করে স্কুলে যাওয়া সদ্য কিশোরটি দু’বেলা সেই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ঘুরঘুর করা শুরু করে, তাঁকে নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করে। সেলুন, মুদিখানা, বাজার, কিটি পার্টি -- সর্বত্র রসালো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যান মালেনা। পাড়ার বহু মহিলার বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয় যে, তাঁদের স্বামীটি মালেনা-র সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। ঠিক এক যুগ আগে মুক্তি পাওয়া মোনিকা বালুচ্চি অভিনীত বহু আলোচিত ইতালিয়ান ছবি ‘মালেনা’-র গল্প শুরু হচ্ছে এই ভাবে।
সিনেমায় যেমন হয়, বাস্তবেও অনেকটা তাই। একা থাকা মেয়েকে নিয়ে পারিপার্শ্বের আকণ্ঠ কৌতূহল। তার বাড়িতে কে এল, সে কোথায় গেল, ক’টায় বাড়ি ফিরল, তার ঘরের সামনে কার চটি পড়ে আছে সব কিছুই চর্চার বিষয়। বিয়ে-বাচ্চা-বরের তেকোনা সামাজিক বাধ্যতার বাইরে একটা মেয়ের একা বাঁচতে চাওয়া মানেই গতানুতিক ভাবনার জমিতে ভূমিকম্প হওয়া। একা নিজের মতো বাঁচতে চাওয়ার সাহস পেয়ে যাওয়া মানে তো বিদ্রোহের সঙ্কেত। সেই মেয়ের নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা রয়েছে, নয়তো সে ‘খারাপ’ বা অন্য ভাবে বললে ‘সহজলভ্য’। তবুও আগ্রহ, সন্দেহ, গসিপের তোয়াক্কা না-করে একলা মেয়ের একা থাকার টান চৌগুণ হয়েছে তথাকথিত রক্ষণশীল এই কলকাতাতেও।
এ শহরে একাবাসিনীদের কারও বয়স বিশের ঘরে, কেউ তিরিশ, পঞ্চাশ বা সত্তরের কোঠায়। কেউ স্বেচ্ছায় একা বসবাস বেছেছেন, কেউ বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে একা হয়েছেন এবং সাবলীল মাধুর্যে সেটা গ্রহণ করে চমকে দিয়েছেন। এই একাবাসিনীদের অনেকেই এখন স্বীকার করেন, একা থাকা-টা ক্রমশ একটা নেশার মতো হয়ে যায়। টয়লেটের ছিটকিনি না-আটকে স্নান করতে পারার মধ্যে যে উদ্দাম স্বাধীনতা, তার স্বাদ একবার পেলে ফেরা মুশকিল।
তা হলে কি বদলে যাচ্ছে সমাজের কাঠামো? বোহেমিয়ান, ছুঁৎমার্গহীন জীবনের প্রতি আকর্ষণ ক্রমশ একক জীবনে পুরে দিচ্ছে মেয়েদের? সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন, ভুল। ইচ্ছেটা অতীতেও অনেকের মধ্যেই ছিল। কিন্তু আর্থসামাজিক অবস্থার জন্য সেই সব মেয়ের ইচ্ছা মনেই থেকে গিয়েছে। এখনও তাঁদের অনেককে কাছের লোকেদের বলতে শোনা যায়, “মানসিক ভাবে একা হয়েছিলাম অনেক দিন। কিন্তু রোজগার করি না বলে আর ছেলেমেয়ে হয়ে গিয়েছে বলে ছেড়ে যাওয়া হল না। মেরুদণ্ডটা বেঁকে গিয়েছিল তত দিনে। শক্তিটা জুগিয়ে উঠতে পারলাম না।”
সমাজতাত্ত্বিক আর মনোবিদরাই বলছেন, এখন অধিকাংশ মেয়েরই বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অনেক খোলামেলা। প্রায় প্রত্যেকেই আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর, তাঁদের নিজস্ব ভাবনা, স্বাধীনতাবোধ, মতপ্রকাশের জায়গাটা খুব স্পষ্ট। ফলে দোনামনায় না থেকে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা দেরি করছেন না। |
|
মৌ-এর কথাই ধরা যাক। আমহার্স্ট স্ট্রিটের যৌথ পরিবারে বড় হওয়া মৌ ভট্টাচার্য। বছর বিয়াল্লিশের মৌ আপাতত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। যাদবপুরের ফ্ল্যাটে একা থাকেন। স্বামী অদ্রীশ অধ্যাপকের চাকরি নিয়ে থাকেন রায়গঞ্জে। অদ্রীশ ছুটি পেলে কলকাতায় আসেন আর মৌ ছুটি পেলে রায়গঞ্জ যান। মৌ-এর কথায়, “আমরা জানি পরস্পরকে কতটা স্পেস দিতে হবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গাটাও অটুট রয়েছে। অন্যরা এই থাকা নিয়ে বিশেষ ঘাঁটানোর সাহস পান না।”
কিন্তু অন্য কোনও রকম সমস্যা, কোনও ভয়, নিরাপত্তাহীনতা চেপে বসে না? মৌ বলেন, “ভূতের ভয় নেই, তবে মানুষের ভয় আছে। আমাদের শহরে মেয়েদের জন্য হেল্পলাইন ব্যাপারটা এত কম ভাবা যায় না। আমি একা একটা ফ্ল্যাটে থাকি, মোটামুটি সুদর্শন, তার লোভে অনেক পুরুষই চটাপট ঘনিষ্ঠ হতে চায়। এই জায়গায় খুব শক্ত হতে হয়।”
একই বক্তব্য পারমিতার। পারমিতা সেনগুপ্ত। বয়স তেত্রিশ। ডিভোর্স হওয়ার পর বাগবাজারে নিজের ফ্ল্যাটে একা থাকেন। কাছেই বাবা-মায়ের বাড়ি। তাঁদের সঙ্গে থাকতেই পারতেন, কিন্তু পারমিতার আত্মমর্যাদাবোধ সায় দেয়নি। বহুজাতিক সংস্থার উঁচু পদে কাজ করেন। তাঁর অভিজ্ঞতায়, যে মুহূর্তে লোকে জানবে যে, একটা মেয়ে একা থাকে তখনই বেশির ভাগ পুরুষ মনে করবে মেয়েটা সহজলভ্য বা তাকে খুব সহজে দমিয়ে রাখা যায়।
ড্রাইভার থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সবাই অপদস্থ করার চেষ্টা করবে। পারমিতা বলেন, “একা থাকা শুরু করার পর আমি বাহ্যিক ভাবে অনেক রুক্ষ হয়ে গিয়েছি। নরম হলেই মুশকিল।”
সংবিদার বয়স আরও খানিকটা কম। পঁচিশের সংবিদা পাহাড়ি তেইশ বছর বয়স থেকে কলকাতায় একা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। প্রথমে থাকতেন কসবায়, এখন দমদমে। নিজের বাড়ি আদ্রায়। পেয়িং গেস্ট হিসাবে বা হোস্টেলে থাকতে পারতেন। আলাদা বাড়ি ভাড়া কেন? একটি সংবাদপত্রের সাব-এডিটর সংবিদার ইনহিবিশন-মুক্ত জবাব, “আমার বাবা-মা কলকাতায় এলে যেমন তাঁদের জন্য একটা স্পেস দরকার, তেমনই আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা বাড়ি দরকার ছিল। হয়তো আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমার বাড়িতে বসে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে, পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকলে তার জন্য আমাকে উনত্রিশ রকমের কৈফিয়ত দিতে হবে। তাই বাড়ি ভাড়া নেওয়া।” ভাড়া পেতে অবশ্য হ্যাপা কম নয়। এখনও একলা মেয়েকে থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া গিতে গেলে বাড়িওয়ালা একাশিবার ভাবেন, অসংখ্য প্রশ্নও করেন।
রাত্রি একা থাকেন প্রায় ছ’বছর। রাত্রি চক্রবর্তী। তেরো বছরের যন্ত্রণাদায়ক বিবাহিত জীবনে দাঁড়ি টেনে কালিকাপুরে নিজের কেনা এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেছিলেন। কাজ শেষে অনেক রাতে একা বাইক চালিয়ে বাড়ি ফেরেন। বলেন, “একা থাকতে গেলে মানসিক ভাবে অনেক শক্ত হতে হবে আর টাকাপয়সা খুব পরিকল্পনা করে খরচ করতে হবে। সঞ্চয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি একটা ছোট অথচ জোরালো বন্ধু-সার্কেল রাখতে হবে। বাড়ির কাজ কখন কী করতে হবে, কী কিনতে হবে লিস্ট করে রাখতে হবে। মোবাইলে প্রয়োজনীয় সব নম্বর রেখে দিতে হবে আর নিজস্ব একটা যানবাহন রাখতে পারলে খুব ভাল।”
এঁরা তো হলেন সব তিরিশ-চল্লিশের কোঠায়। আরও অনেকে রয়েছেন যাঁদের বয়স পঞ্চাশ থেকে আশির ঘরে। বাগুইআটির গৌরী গুহঠাকুরতা, বনহুগলির সর্বাণী বসু, কামালগাজির শাশ্বতী দাশগুপ্ত, বাগুইআটির চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকে। ছেলেমেয়ের বোঝা হতে চাননি বলে এঁদের অনেকে একা থাকা বেছেছেন, কেউ জীবনের একটা স্তরে এসে বুঝেছেন, মরে যাওয়া দাম্পত্য টেনে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন।
কখনও-কখনও একাকীত্ব এঁদের গ্রাস করে না, তা নয়। টিভি সিরিয়ালের পাত্রপাত্রীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের সঙ্গে একা-একাই হাসেন-কাঁদেন। বাড়ির ঠিকে কাজের লোকের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়াই হয়তো বেশি কথা বলেন। শরীরের জোরও কমেছে, অসুখ-বিসুখ নিয়ে সমস্যা বাড়ছে। তা-ও জীবনে হেরে যাওয়ার পাত্রী নন এঁরা। কেউ চুটিয়ে একা সিনেমা দেখেন, কেউ ভালমন্দ রান্না করে বস্তির ছেলেমেয়েদের খাওয়ান, বয়স্ক কাজের মেয়েদের পড়ান, কেউ সুন্দর করে সেজেগুজে বন্ধুদের সঙ্গে কফি খেতে যান, বাড়িতে আড্ডার আসর বসান, ছবি আঁকেন, গান করেন। জীবনটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগে কসুর করেন না।
৩৬ চৌরঙ্গি লেনের শিক্ষিকা ভায়োলেট স্টোনহ্যাম-কে মনে আছে? নিঃসঙ্গ, বয়স্ক শিক্ষিকার বেড়াল নিয়ে বসবাস। হঠাৎ পুরনো ছাত্রী নন্দিতা আর তাঁর প্রেমিক সমরেশের সান্নিধ্যে জীবন ভরাট হতে শুরু করে ভায়োলেটের। তখনই ধাক্কা আসে নন্দিতাদের দিক থেকে। ভায়োলেট বুঝতে পারেন কতটা অপাংক্তেয় তিনি। এখনকার একাবাসিনী গৌরী, সর্বাণীরা কিন্তু ভায়োলেট নন। বরং তাঁরা ‘শুভমহরত’- ছবিতে রাখী-অভিনীত দাপুটে রাঙাপিসিমার ক্লোন। যাঁরা বেড়াল নিয়ে সংসার করলেও একাকীত্বের পরোয়া করেন না। একলা মেয়ের একা থাকার মজাগুলো কোথায় লুকিয়ে আছে সেটা খুঁজে বার করার গোয়েন্দাগিরিতে তাঁরা ওস্তাদ। |
একা থাকার জন্য জরুরি |
• বাড়ি ভাড়া বা ফ্ল্যাট কেনার আগে পাড়া ও এলাকার পরিবেশ যাচাই করুন |
• বাড়ির দরজা সব সময় লক করে রাখা অভ্যাস করুন |
• সম্ভব হলে একটি পোষ্য রাখুন |
• নিজের আত্মরক্ষার জন্য ছোট ছুরি, লঙ্কার গুঁড়ো, পেপার স্প্রে বা কিছু একটা রাখুন। কিছু দরকারি ওষুধ, ইমার্জেন্সি লাইট রাখুন |
• নিজের মোবাইল এবং পার্সোনাল ডায়রিতে ধোপা, ইলেকট্রিশিয়ান, গ্যাস, কলের মিস্ত্রি, ডাক্তার, অ্যাম্বুল্যান্স থেকে স্থানীয় থানা সব নম্বর রাখুন |
• লোক বুঝে মিশুন। আলাপের ব্যাপারে চুজি হন। ঠিকা কাজের লোক রাখলেও স্থানীয় থানায় তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে রাখুন |
• আশপাশের অন্তত একজন প্রতিবেশী বা পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখুন, যাতে রাতবিরেতে দরকার হলে সাহায্য মেলে |
• নির্দিষ্ট ব্যবধানে নিকটাত্মীয় বা প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন বা তাঁদের নিজের বাড়িতে ডাকুন |
• বাল্ব লাগানো, ফিউজ ঠিক করা, গাড়ি থাকলে গাড়ির ছোটখাট কাজ, গ্যাসের পাইপ লাগানোর মতো কিছু টুকটাক কাজ শিখতে হবে |
• নিয়মিত বেড়াতে যান। এখন অনেক ট্র্যাভেল এজেন্সি শুধু মেয়েদের জন্য আলাদা ট্রিপ আয়োজন করে |
• নিজের ভাললাগার যে কোনও জিনিস খাওয়া, গান, নাচ, বই পড়া, ছবি আঁকা, সাঁতার কোনও কিছুতে সমঝোতা করবেন না |
|
|
|
|
|
|