অঞ্জন-ব্যঞ্জন
টাটকা তাজা খেতে মজা
জীবনটা ভাজাভাজা হয়ে গেল!
একমাত্র নির্দোষ চানাচুর ছাড়া আর কে এমন সহজ স্বীকারোক্তি করতে পারে? আর কে পারে এমন কম মার্কেট ক্যাপ নিয়ে বাঙালির জীবনে এমন বিরাট শেয়ার এনজয় করতে? হরিদাসের বুলবুলভাজা যুগ যুগ জিও! টাটকা তাজা খেতে মজা! আজকের রাজস্থানি ভুজিয়াওয়ালাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অনেক আগে থেকেই বাঙালি এই চানাচুর বস্তুটির বড় সমঝদার। চায়ের সঙ্গে, মুড়ির সঙ্গে, এমনকী নিঃসঙ্গেও এর মজা জাস্ট আনপ্যারালাল!
চানাচুরের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে অন্য কেউ গবেষণা করুন, আমার ইন্টারেস্ট শুধু তার বাংলা-ছড়ানো জিওগ্রাফিতে। ক্যানিং থেকে বর্ধমান, রানাঘাট থেকে হাসনাবাদ, উলুবেড়ে থেকে লালগোলা, কোন লাইনে নেই এক-একটি বিশিষ্ট বাঙালি চানাচুর ব্র্যান্ড! প্রত্যেকটির স্বাদ অন্যটির চেয়ে আলাদা, গোত্রে অভিন্ন। আমরা অনেক কুটিরশিল্পেরই যেমন কদর করি না— চানাচুর তেমনই অবহেলিত, অসংগঠিত একটি ক্ষেত্র। মাড়োয়ারি ব্যবসাদারেরা কিন্তু চানাচুরের তুতো ভাই ভুজিয়াকে রীতিমতো আন্তর্জাতিক করে ছেড়েছে। সেই পুরনো কিসসা‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি!’
যদিও আমার পরিচিত এ রকম বহু ‘এক কালে বেকার, এখন রীতিমতো গোলাকার’ বাঙালি যুবক আছেন, যাঁদের কর্মজীবন শুরু এই চানাচুর বেচে। পরে তাঁরা হয়তো আরও কুলীনতর ব্যবসার সন্ধান পেয়ে চানাচুরের ঠোঙাটি দূরে সরিয়ে রেখেছেন। অবশ্য শুধু চানাচুর বেচে আইকন হয়ে উঠেছেন, এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ কলকাতার বুকেই আছেএক ও একমাত্র উজ্জ্বলা! উজ্জ্বলার চানাচুর একটি কাল্ট বিশেষ।
কলকাতার এককালীন সিনেমা হল-সংস্কৃতির নিবুনিবু প্রদীপে শিবরাত্রির সলতে। মনে পড়ে, এক সময়ে বাংলার সব সিনেমা হলের চত্বরেই এ রকম এক-একটি চানাচুরের ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব ছিল। মাল্টিপ্লেক্স আর শপিং মলের ভারে সেগুলো তখনও চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যায়নি। তো, উজ্জ্বলার চানাচুর কিন্তু আজও লোকে গাড়ি থামিয়ে লাইন দিয়ে কেনে। এই না হলে ব্র্যান্ড! কলকাতার বনেদি পানশালাগুলোতে আজও উজ্জ্বলার চানাচুর সার্ভড হয়, সহযোগী চাট হিসেবে।
আর একটা জিনিসের উল্লেখ না করলে চানাচুর কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সে হল ঘটি-গরম। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের সন্ধ্যায় সেই টুং-টুং আওয়াজ আর গরম-গরম চানাচুর, আজও আমার হট ফেভারিট! সংখ্যায় তাঁরা হয়তো আজ সংখ্যালঘু, কিন্তু কান পাতলে আজও পাড়ায় পাড়ায় হঠাৎ হঠাৎ তাঁদের আহ্বান শোনা যায় বইকী! কেরোসিনের গন্ধ মাখা গরম চানাচুরের সঙ্গে অ্যাড অন পেঁয়াজ-লঙ্কায় সেই ঘটি-গরম— আহা, লা জবাব! লোকে তো কত কিছুকেই প্যাকেটবন্দি করছে আজকাল। কিন্তু ঘটি-গরমের কাছে সব প্যাকেজিং ঠান্ডা। আজও সে খোলা এবং আন-ব্র্যান্ডেড। ভাগ্যিস!
চানাচুরের অনেক অবতার। কখনও সে মুখরোচক, কখনও ডালমুট, কখনও পাপড়ি চানাচুর, কখনও বা গাঠিয়া। বহুরূপে হৃদিবিরাজে এই সুস্বাদু আহার। বোলপুর লাইনের ‘বিল্বদার চানাচুর’ থেকে কলকাতা শহরতলির ‘বাপি চানাচুর’— জয়যাত্রা অব্যাহত। এমনকী, ঘরের পাশে বাংলাদেশেও দেখেছি এর কদর সাঙ্ঘাতিক। সেখানকার ‘বনফুলের চানাচুর’ তো ঘরে ঘরে আদৃত। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও চানাচুরের রমরমা। উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত ‘আগ্রা চানাচুর’ বা কেরলের কারিপাতা-দেওয়া ‘স্পেশাল সাউথ ইন্ডিয়ান চানাচুর’ কেউই কারও চেয়ে কম যায় না! আর খ্যাতি শুধু দেশে বা প্রতিবেশী দেশেই নয়, এমনকী বিলেতেও চানাচুর চলে বিখ্যাত ‘বম্বে স্ন্যাকস’ নামে।
একদা অফিসফেরত বাঙালির প্রিয় স্ন্যাকস ছিল এই চানাচুর। সারা দিনের বিস্বাদ ভুলে মুখে স্বাদ আনত এই মুখরোচক বস্তুটি। বড় জামবাটিতে মুড়ি ও কাঁচালঙ্কা সহযোগে সে টিফিনের চল এখনকার লেট-নাইট ফেরত বাঙালিদের মধ্যে আর তত জনপ্রিয় নয়। এমনকী, স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়েও কেউ কেউ স্বাদু বস্তুটি থেকে আজকাল দূরে থাকেন। তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চানাচুর এত সহজে হারিয়ে যাওয়ার বা হেরে যাওয়ার পাবলিক নয়। ঠিকঠাক কোয়ালিটি আর কিঞ্চিৎ আজকালকার মার্কেটিং বুদ্ধি মিশিয়ে দিলেই চানাচুর আজও পাবলিক হেভি খায়, হেভি খাবে!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.