ব্যাগ গুছিয়ে...
যেন আর এক মথুরা
কটা ছোট্ট দ্বীপ। সমুদ্রে চার ধার ঘেরা। সেখানে শব্দ বলতে শুধু অশান্ত ঝড়ের শব্দ। হালকা কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ছুটে চলেছি। সেই অজানা দ্বীপের সন্ধানে দুর্দান্ত একটা ভিলেজস্কেপ। নারকেল গাছের মায়ামাখা রাস্তার দু’পাশে সরল গ্রাম জীবনের ছবি। নাম-না-জানা জেলেপাড়া ছাড়িয়ে গাড়িটা এসে থামল। দক্ষিণ কর্নাটকের সমুদ্রে ঘেরা মালপে বন্দরের মুখে হাজার হাজার ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই কাকভোরে গভীর সমুদ্র ছেঁচে মাছ নিয়ে ফিরছে। বোট অফিস থেকে টিকিট কেটে লঞ্চে উঠতেই মালপে নদীর বুক বেয়ে আরবসাগরের দামাল ঢেউয়ের মুখোমুখি। খড়কুটোর মতো ভেসে চলেছি। সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডুবো পাথরের পাহাড়। সাবধানী সারেঙ সেই সব ডুবো ব্যাসল্ট পাথর সযত্নে এড়িয়ে এগিয়ে যেতেই দূরে একটা কালচে-লাল-সবুজের রেখা স্পষ্ট হল। ১৪৯৮-এ ভাস্কো দ্য গামা এই দ্বীপটিতে পা রেখেছিলেন। নাম রেখেছিলেন পাদ্রো-দ্য-সান্তা-মারিয়া। পরবর্তী কালে এই দ্বীপের নাম হল সেন্ট মেরি দ্বীপ। রোমাঞ্চকর জলযাত্রার শেষে দ্বীপে পা রাখতেই মুগ্ধতার ছোঁয়া লাগল। নারকেল গাছ আর কালচে লাল ব্যাসল্টের বুকে সোনালি বালির উষ্ণতায় সুন্দরের সেরা ঠিকানা।
অর্ধচন্দ্রাকৃতির সেন্ট মেরি দ্বীপভূমি। অশান্ত এলো হাওয়ায় মাছলোভী সিগালদের ওড়াওড়ি ঘন নীল আকাশের বুকে। স্নান করা নিষেধ থাকলেও রোমাঞ্চমাখা নীল-সবুজের দ্বীপে হারিয়ে যেতে কোনও মানা নেই। সমুদ্রের অপার নির্জনতায় ঢেউয়ের ভাঙাগড়া দেখতে দেখতে ডাক দেয় সারেঙ। আবার ঢেউয়ে দুলতে দুলতে ফেরত আসা।
কর্নাটকের পৌরাণিক শহর উদুপি। সহ্যাদ্রি পাহাড়ের কোলে আধুনিক শহরটাকে আরবসাগর ঘিরে রেখেছে। মল, রেস্তোরাঁ, হোটেলের ছড়াছড়ি উদুপিতে। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে গেলেই চমকে যাওয়ার পালা। আস্ত আধুনিক শহরটা ভোল বদলেছে পৌরাণিক রূপরেখায়। সুন্দর মঠ-মন্দির, নিকোনো উঠোন। উঁচু দালানবাড়ির সামনে আলপনা। ধূপের সুগন্ধে ম ম করছে। মাইকে বেদমন্ত্রের উপাসনা। কন্নড় ভাষায় ‘উদুপি’ হল ‘চাঁদের শহর’। দূরে মাখনরঙা মন্দিরের দেবতা ‘কানাকানা কিনাদি’ মানে শ্রীকৃষ্ণ। তিনি শহরের এই বৈষ্ণব মহল্লার একচ্ছত্র অধিপতি। বৈষ্ণবগুরু মাধবাচার্য পরশুরামক্ষেত্রের এই শহরে মন্দির ও মঠের নির্মাণ করেছিলেন। দুপুরে মন্দির বন্ধ থাকে। শোনা যায়, উদুপিতেই প্রথম মশালা দোসার আবিষ্কার। ঢুকে পড়লাম রেস্তোরাঁয়। অর্ডার দিতেই বিশাল মশালা দোসা হাজির। সবুজ কলাপাতার উপরে ঘিয়ে-রঙা দোসার মাঝে আলু, পেঁয়াজ আর কারিপাতার সঙ্গতে অনবদ্য স্বাদের পুর। সঙ্গে সম্বর আর নারকেলের ঘন চাটনি।
উদুপির কৃষ্ণমন্দিরে পৌঁছতে গিয়ে দেখা মিলবে সুদৃশ্য রথের। ভূভারতে এমন অদ্ভুতদর্শন রথ আগে কোথাও চোখে পড়েনি। বিশাল রথের সেগুন কাঠের কারুকাজ। উপরে লালহলুদের মিশ্রণ। কাঁচা সোনারঙা রোদ কামড়ে বসেছে। তামিলনাড়ুর পুস্পহারের শিল্পীদের কাজের অপরূপ নিদর্শন আজও বিস্ময়ের। মন্দির ও রথের গায়ে ফুটে উঠেছে রামায়ণ-মহাভারতের নানান ঘটনা। বিশাল কাঠের চাকার মাঝখানে দেবতার আসন। উপরে বৃত্তাকার লাল-হলুদের মোড়ক। পুরুষদের খালি গায়ে মন্দিরে প্রবেশ করাটাই রীতি। এক মন্দির কমপ্লেক্সে আরও অনেক মন্দির। ইতিহাস আর কিংবদন্তির ছড়াছড়ি এই শ্রীকৃষ্ণমন্দির জুড়ে। শোনা যায় মাতা দেবকী শ্রীকৃষ্ণের ছোট্টবেলা দেখতে চাইলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তখন বড় হয়ে গিয়েছেন। তাই শ্রীকৃষ্ণ দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে অনুরোধ করেন তাঁর ছোট্টবেলার মূর্তি নির্মাণ করতে। বিশ্বকর্মা তখন এই বালকৃষ্ণের মূর্তি গড়লেন, যার এক হাতে এক মুঠো মাখন ও অন্য হাতে ছোট্ট লাঠি। কষ্টিপাথরের এই মূর্তিটি অনেক কাল পরে বৈষ্ণবগুরু মাধবাচার্যের হাতে আসে। সেই থেকে অষ্টোত্তর শতনামধারী শ্রীকৃষ্ণ উদুপিতে নিত্যপুজো পেয়ে আসছেন।
বিকেলের মিষ্টি রোদে শহর থেকে সামান্য দূরের মালপে সৈকতে যেতেই পলকে ধরা দিল আরবসাগর। ঝাউ, নারকেল আর সোনালি বালির সৈকতপ্রান্তে ঝিনুকের নানান সামগ্রী আর সি-ফুডের স্টল চোখে পড়বে। নীল আকাশপ্রান্তে রামধনু-রঙা বিশাল বেলুন ভেসে বেড়াচ্ছে। অজানা সাগরবেলাকে পাখির চোখে দেখে নেওয়া প্যারাসেলিংয়ের রোমাঞ্চকর রাইডে। আরব সাগরের অশান্ত বুকে ওয়াটার স্কুটার, বানানা রাইডে উত্তাল ঢেউয়ের ওঠাপড়ায় মেতে ওঠা যায় অনায়াসে। সোনালি বালুকাবেলার মালপে সৈকতে শান্ত নীল সমুদ্রে স্নানবিলাসীরা মেতে উঠেছেন আনন্দস্নানে। আকাশে তখন অস্তরাগ।
পিতলরঙা সূর্যটা ক্রমশ গাঢ় লাল হতে হতে একসময় ঝুপ করে ডুব দিল আরবসাগরের জলে। চাঁদের শহরে চাঁদের আভাস পাওয়া গেল। তারায় ভরা আকাশটাকে সঙ্গী করে উদুপি ফিরতেই আরও এক চমক। শ্রীকৃষ্ণের রাজকীয় নগর পরিক্রমা। রঙিন রথ আলোকমালায় সেজে উঠেছে। রাজকীয় বৈভবে সোনার ছোট্ট কৃষ্ণমূর্তি মন্দির থেকে বের হলেন সোনার পালকি চড়ে। বেজে উঠল ঢোল নাকাড়া, বিউগল। রথের রশিতে পড়ল টান। নীল চাঁদের জ্যোৎস্নায় মাখামাখি গোটা মহল্লায়। রাজকীয় ঢঙে সজ্জিত হাতি গোটা যাত্রাপথে পুরোভাগে থেকে তদারকি করছে। তারই পিছনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের রথ। এ যেন অকালে রথযাত্রা। হঠাৎ কালচে নীল আকাশের সীমান্তে আতসবাজির রোশনাই। সমস্ত অন্ধকার ঘুচে আলোর রোশনাই মাখা সন্ধে। এক দিন নয়, প্রতিদিন উদুপিতে সান্ধ্য পরিক্রমা করেন বালকৃষ্ণ ওরফে ‘কানাকানি কিনাদি’। প্রতিটি সন্ধে হয় রঙিন। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ১৭-১৮ তারিখে উদুপিতে চলে পর্যায়া মহোৎসব।
কৃষ্ণমন্দির ছাড়াও উদুপিতে রয়েছে নানান মঠ। শ্রীপালিমার মঠ, কৃষ্ণপুরা মঠ, শ্রীশোর মঠ-সহ প্রায় ২০টি মঠ দেখে নেওয়া যায়।
কে বলে, কৃষ্ণ শুধু মথুরা, দ্বারকা কিংবা বৃন্দাবনে আছেন?

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে মহীশূর হয়ে ট্রেনে অথবা গাড়িতে উদুপি আসতে হয়।
উদুপি থেকে সেন্টমেরি ১৫ কিলোমিটার। মালপে বন্দর থেকে লঞ্চে আসতে হয়।
কোথায় থাকবেন
উদুপিতে থাকার প্রচুর হোটেল আছে। সিজন অনুযায়ী রেট বাড়ে কমে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.