ডেভিস কাপে নতুন ভারতের প্রথম শোয়ের চিত্রনাট্যে করুণ হাস্যরস!
প্রথম সিঙ্গলসে ভারত যাকে দলের এক নম্বর প্লেয়ার হিসেবে নামিয়েছিল, সেই ভি এম রঞ্জিতের ম্যাচ যেন ‘কমেডি অব এররস’! জাতীয় দলের হয়ে আবির্ভাব ম্যাচে চেন্নাইয়ের সাতাশ বছরের ছেলেকে মনে হল ডিএলটিএ-র কোনও টেনিস শিক্ষানবিশ। দক্ষিণ কোরিয়ার এটিপি র্যাঙ্কিং-হীন চো-র কাছে তাঁর দেড় ঘণ্টার মধ্যে ১-৬, ০-৬, ১-৬ উড়ে যাওয়ার ছবি দেখতে দেখতে গ্যালারি বেশ কয়েক বার হেসেই ফেলল! চো শুধু বলটা রঞ্জিতের কোর্টে ফেলে গেলেন। তার পর যত রকম ভুলভাল টেনিস খেলা যায়, আগাগোড়া খেললেন রঞ্জিত। গোটা ম্যাচে নিজের দশটা সার্ভিস গেমের মধ্যে সাকূল্যে একটা জিততে পেরেছেন। সেটাও তৃতীয় সেটে পৌঁছে। এর কাছেও যে কী করে একটা সার্ভিস খোয়ালেন চো, সেটা গত দু’বছর তাঁর দেশের সরকারের বাধ্যতামূলক আর্মিতে যোগ দেওয়ার কারণে এটিপি সার্কিটের বাইরে থাকা কোরিয়ান বোধহয় আজ সারা রাত ভাববেন। রঞ্জিতের হাস্যকর খেলার চেয়েও ম্যাচের পরে তাঁর মন্তব্য আরও হাসির উদ্রেক করল মিডিয়ায়। “আমার তো মনে হচ্ছে, আমি আজ ভালই খেলেছি। চো আসলে অসাধারণ খেলেছে।” যিনি দোভাষীর মাধ্যমে জানালেন, “যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও সহজে জিতেছি।” |
দুই সময় দুই মেজাজ |
|
|
টাই শুরুর আগে: অ্যাড্রিনালিনের নাম লিয়েন্ডার
পেজ। ম্যাচ শুরুর আগে টিমকে তাতানোর চেষ্টা |
০-১ পিছিয়ে: পিছিয়ে পড়ে উদ্বিগ্ন
(সামনে বিধ্বস্ত রঞ্জিত) |
|
দ্বিতীয় রাবার আবার নিখাদ হৃদয়বিদারক। পানিপথের বিজয়ন্ত মালিক যেন তাঁর জন্মস্থানের নামের ঐতিহ্য রেখে প্রাণপণ যুদ্ধ করছিলেন কোরিয়ার সেরা প্লেয়ার জিওংয়ের বিরুদ্ধে। হারলেও এক ইঞ্চি মেদিনী বিনা লড়াইয়ে ছাড়ব না গোছের টেনিস খেলে প্রথম দুটো সেট ৪-৬, ৫-৭ হারার পর তৃতীয় সেটের ঠিক আগে বাঁ পায়ে ক্র্যাম্প ধরিয়ে বসেন বিজয়ন্ত। কোর্টের ধারেই নতুন টিম ডাক্তারের একপ্রস্ত শুশ্রূষা নিয়ে তৃতীয় সেট শুরু করেছিলেন বটে। কিন্তু ০-২ অবস্থায় তৃতীয় গেমে একটা রিটার্ন শট মারার সময় বেসলাইনে লুটিয়ে পড়ার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। বিজয়ন্ত ম্যাচ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় কোরিয়ানরা প্রথম দিনের শেষে ২-০ এগিয়ে। এবং তাঁদের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন বলে গেলেন, “সপ্তাহখানেক আগে এখানে যখন এসেছিলাম, সত্যিই কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ডাবলসেও জিতে কালই টাই-টা পকেটে পুরে ফেলতে পারব।”
উল্টো দিকের শিবিরে তখন একটার পর একটা করুণ অঙ্ক অভিনীত হয়ে চলেছে। যার সবের শেষে যেন শূন্য অঙ্ক! বিদ্রোহী প্লেয়ার জোটের ‘আমাদের দাবি না মানলে দেশের হয়ে খেলব না’-র হুমকিতে এআইটিএ যেটা সবচেয়ে ভয় পেয়েছিল, ঠিক সেটাই ঘটল আজ। তৃতীয় সারির দল নিয়ে নেমে ডেভিসে দেশের মুখ পুড়ল। যেখান থেকে সেরে ওঠা পরের দু’দিনে কার্যত অসম্ভব। তার জন্য বাকি তিনটে ম্যাচই জিততে হবে। যতই কাল ডাবলসে লিয়েন্ডার পেজ নামটা ভারতীয় জুটিতে থাক না কেন? বিজয়ন্ত সুস্থ হয়ে না উঠতে পারলে তো রবিবার শেষ রিভার্স সিঙ্গলস খেলার লোক নেই এই ভারতীয় দলে। লি-কেই না অনুনয়-বিনয় করতে হয়।
আজও যিনি বিজয়ন্তের ম্যাচের সময় ভারতের রিজার্ভ বেঞ্চ থেকেই বিরাট জাতীয় পতাকা নিয়ে নাড়াচ্ছিলেন। যাতে কোর্টের ভেতর তাঁর অখ্যাত, আনকোরা টিমমেট তেতে ওঠেন। না কি লিয়েন্ডার দ্বিতীয় সেট থেকেই বুঝেছিলেন, বছর বাইশের বিজয়ন্তের তীব্র লড়াইয়ের ইচ্ছে থাকলেও তাঁর পা আর চলছে না! চণ্ডীগড়ের আদিবাসী শিশু প্রকল্পের অন্তর্গত টেনিস কোচিং ক্যাম্পে আট বছরের বিজয়ন্তের প্রতিভা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন আখতার আলি। লিয়েন্ডারের মতো আখতারেরও ধারণা, দ্বিতীয় সেট থেকেই বিজয়ন্তের আরও বেশি নুন-জল খাওয়া দরকার ছিল দু’টো গেম অন্তর কোর্ট বদলের সময় নিয়মমাফিক এক মিনিটের প্রতিটা বিরতিতে। তা হলে আর ম্যাচ থেকে রিটায়ার করে নার্সিংহোম ছুটতে হত না স্যালাইন নিতে। |
উদ্বোধনে সানিয়া মির্জা। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। |
কিন্তু ভারতীয় টেনিসকে কি এই মহাসঙ্কটে স্যালাইন দিয়েও দাঁড় করানো যাবে? কত বার যে আজ এইআইটিএ-র মুখ পুড়ল! বিজয়ন্তকে ও ভাবে লুটিয়ে পড়তে দেখে ভিআইপি এনক্লোজার থেকে তরতরিয়ে নেমে এলেন ডা. ভেস পেজ। মহেশদের জোটের দাবি মেনে দু’দশকেরও পুরনো যে টিম ডাক্তারকে ডেভিস কাপ দল থেকে সরিয়ে দিয়েছে ফেডারেশন। লিয়েন্ডারের বাবা যখন ডেভিস কাপ কর্তৃপক্ষের কাছে কোর্টে ঢোকার অনুমতি নিচ্ছেন, ছবিটা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল! পরের আধ ঘণ্টা ভেস পেজের পরামর্শেই বিজয়ন্তকে মাসাজ করলেন নতুন টিম ডাক্তার।
দশ-পনেরো হাত দূরেই কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন য়ুকি ভামব্রি। উল্টো দিকের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে তাঁর কোচ আদিত্য সচদেব চিবিয়ে চিবিয়ে জনৈক পরিচিতকে বলছেন, “দু’-একদিন পরেই তো য়ুকি, সনম, বিষ্ণু, দ্বিবীজকে নিয়ে তিন সপ্তাহের জন্য ইউরোপিয়ান চ্যালেঞ্জার ট্যুরে বেরিয়ে যাচ্ছি। ওরা চার জন প্লেয়ারই তো এখন এখানে।” হ্যাঁ, ওঁরা শুধুই ‘চার জন’ নয়। এগারো বিদ্রোহীর চার জন! আর আদিত্য সচদেবকেই ডেভিসে কোচ করতে হবে, দাবি ছিল জোটের। অদৃষ্টের পরিহাস বোধহয় একেই বলে। নইলে কী আর য়ুকি আজ বলেন, “খন্না স্টেডিয়ামে জীবনে এই প্রথম বার কোর্টের ভেতর না থেকে গ্যালারিতে বসে আছি। ভারত খেলছে, আর আমি দেশের হয়ে খেলতে পারছি না, এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে?”
আসলে আর কে খন্না স্টেডিয়ামে সারা দিনটা নাটকীয় যাবে, সেটা বোধহয় সকালটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল! টাই শুরুর আগেই তো নাটক! দু’দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হতে কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের পাশাপাশি হেঁটে কোর্টে ঢুকলেন যুগ্ম প্রধান অতিথি সানিয়া মির্জা। মাস কয়েক আগেই অলিম্পিক মিক্সড ডাবলসের সঙ্গীর সঙ্গে ‘পরিচিত’ হওয়ার সময় লিয়েন্ডারের অট্টহাসি গ্যালারি থেকেও শোনা যাচ্ছিল। সোনালি-হলুদ জিনস্, হাই-বুট, কালো কোট, প্রিন্টেড স্কার্ফে ঝলমলে সানিয়াও তখন হেসে খুন। সানিয়ার এই সময়ই দিল্লিতে প্রমোশনাল কাজে আসার কথা আছে জানতে পেরে শোয়েব মালিকের কাছ থেকে গত পরশু ডেভিস কাপের অফিশিয়াল ডিনারে এআইটিএ-র শীর্ষ কর্তারা আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর স্ত্রীর থাকার ব্যাপারে পাকা কথা আদায় করে নেন।
কিন্তু সানিয়ার গ্ল্যামারাস উপস্থিতি। স্বয়ং লিয়েন্ডারের জাতীয় পতাকা ওড়ানো। গ্যালারিতে কাড়া-নাকাড়া বাজানো। ‘ভারতমাতা কী জয়’ চিৎকারকোনও কিছুই ডেভিসের প্রথম দিন তাতিয়ে তুলতে পারল না নতুন ভারতকে। একটা সময় ‘ভারত মাতার’ ছেলেদের তারস্বরে চিৎকার থেমে গেল। কাড়া-নাকাড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। সানিয়া একমনে মোবাইলে এসএমএস দেখতে লাগলেন, খেলা দেখা ছেড়ে। বিরক্তিতে কোর্টের পাশ থেকে উঠে গিয়ে স্টেডিয়ামের মাথায় ভিআইপি এনক্লোজারে চলে গেলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রাক্তন তারকা ডেভিসকাপাররা।
ডেভিস-উৎসবের আসর হয়ে উঠল ভারতীয় টেনিসের শোকসভা!
|