ধরতাইটা ছিল ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’-এর সামনে দাঁড়িয়ে। ধর্ষণকারীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলালে কি তা সুবিচারে আদৌ সাহায্য করবে? না কি বাধা সৃষ্টি হবে ন্যায়ের রাস্তায়? জবাব খুঁজতে বক্তাদের সুরে সুর মিলিয়ে হাততালিমুখর প্রেক্ষাগৃহও দ্বিধাবিভক্ত। শেষতক কিন্তু দেখা গেল ধর্ষণকারী কোনও ভিন গ্রহের দত্যি-দানো নয়! সামগ্রিক ভাবে সমাজের সর্ব স্তরে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই
যে ধর্ষণের বীজ লুকিয়ে আছে, শুক্রবার সন্ধ্যার কলকাতা তা স্বীকার করে নিল।
বইমেলার মাঠে কলকাতা লিটারারি মিট-এর আসরে তর্কটা উস্কে দিয়েছিলেন সঞ্চালক অপর্ণা সেন। শর্মিলা ঠাকুর বা জাভেদ আখতারেরা কিন্তু স্পষ্ট বললেন, মৃত্যুদণ্ডে সমস্যার সমাধান দেখছেন না তাঁরা। নির্যাতিতা নারীর লুকোনো কান্নার স্বরটুকুও কিন্তু উঠে এল শহুরে আলোচনা-সভার মঞ্চে। শর্মিলা শোনালেন, জয়পুরের এক নাবালিকার গল্প। যৌনাঙ্গে আঘাত, ধর্ষণের সুস্পষ্ট প্রমাণ সত্ত্বেও পুলিশের প্রশ্নের জবাবে যে কোনও প্রিয়জনকে বাঁচাতে মিথ্যে অভিনয় করে যায়। কোনও মতে বলে, কিচ্ছু হয়নি তো! নেহাতই পড়ে গিয়ে চোট লেগেছে। সেই মুহূর্তে দর্শক-শ্রোতারা সকলেই বাক্-স্তব্ধ। |
অসহায় নাবালিকা বা প্রতিবন্ধীর উপরে অত্যাচারের কথা বলেই ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন গুগ্ল ইন্ডিয়া-র কর্পোরেট-কর্ত্রী পরমা রায়চৌধুরী। বলেছিলেন, ওই ঘৃণ্য অপরাধীদের কেন আজীবন সাধারণ নাগরিকের করের টাকায় জেলে পুষে যেতে হবে? শর্মিলা, জাভেদ বা মানবাধিকার কর্মী তথা আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভারেরা উদাহরণ দিয়েই জানালেন, কোনও কোনও দেশে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও ধর্ষণ কমানোর ক্ষেত্রে তা খুব একটা
কাজে আসেনি।
জাভেদ-বৃন্দাদের আরও যুক্তি, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে অনিবার্য মনে নিলে পুরুষতন্ত্রের চিরকেলে ধারণাটিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে দেশে বেশির ভাগ ধর্ষণই চেনা-জানার বৃত্তে, ক’জনকে ফাঁসিতে চড়ানো হবে?
পরিবারের প্রসঙ্গ টেনে বৃন্দার দাবি, অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষিতারা নিজেরাও চান না ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড। ধষর্ণের আইন নিয়ে বিচারপতি বর্মা কমিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ না-থাকাটিকে স্বাগত জানিয়েছেন ওই মানবাধিকার কর্মী। বরং ধর্ষিতার অভিযোগ লিখতে ঢিলেমি-করা ক’জন পুলিশ অফিসারকে জেলে পুরলে তা ঢের কাজে আসবে,সভায় তুমুল হাততালির মধ্যেই বললেন বৃন্দা।
জবরদস্ত বোমাটি কিন্তু ফাটিয়েছেন ‘জাপানিজ ওয়াইফ’-এর গল্পকার কুণাল বসু। শুধু কি ধর্ষণকারীরাই খলনায়ক না কী? তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন বিনোদন-শিল্প তথা চলচ্চিত্রকেও। ‘ম্যায় তন্দুরি চিকেন’ বলে আইটেম-গানের সঙ্গে যখন আমরা নাচানাচি করি, তখন কী হয়? যারা ওই গান বাঁধছেন এবং যাঁরা চেটেপুটে উপভোগ করছেন তাঁরাও কি ধর্ষকের থেকে আলাদা কিছু?
শর্মিলাও মানলেন, পুরুষতন্ত্রের নির্মাণ বা ধর্ষণে প্ররোচনায় বিজ্ঞাপনের ছবিও সমান দোষে দোষী। পরমা বললেন, “গোড়ায় গলদ আমাদের সমাজের মানসিকতায়। আরে, যে সমাজ প্রশ্ন করে দু’বাচ্চার মা অত রাতে পার্ক স্ট্রিটে কী করছিল, সেখানে ধর্ষণের পর তো মেয়েদের ঘাড়েই দোষ চাপানো হবে।”
বক্তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। তাই কিছু স্বর হয়তো অনুচ্চারিতই থেকে গেল। শেষ কথা বললেন সঞ্চালক। অপর্ণার কথায়, “সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমরা মেয়েদের বা লিঙ্গ-বিষয়ক সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার কাজ করতে পারি তো!” এই প্রত্যয়ের সুরেই শেষ হল আলোচনা। |