কলকাতায় যেতে না-পারার জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই আঙুল তুললেন সলমন রুশদি। ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিতর্কিত লেখক শুক্রবার লিখিত বিবৃতি দিয়ে বলেন, “যে দিন কলকাতায় যাওয়ার কথা, তার আগের দিন বলা হল, কলকাতা পুলিশ আমাকে শহরে ঢুকতে দেবে না। এ-ও বলা হল, এ সবই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়।”
শুক্রবার ভারত ছাড়ার আগে তাঁর এক পাতার বিজ্ঞপ্তি সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে গিয়েছেন রুশদি। কিন্তু তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করেননি। শুক্রবার সন্ধ্যায় মহাকরণ ছেড়ে বেরোনোর সময়ে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে মমতা বলেন, “আমি কোনও মন্তব্য করব না।” রাজ্য সরকারের মুখপাত্র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও কিছু বলতে চাননি।
লিখিত বিবৃতি এবং টুইটারের মাধ্যমে রুশদির কিন্তু পরিষ্কার অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীই পুলিশকে দিয়ে তাঁর কলকাতায় আসা আটকেছেন। এমন একটা ইঙ্গিত রুশদি আগের দিনই টুইটারে দিয়েছিলেন। তারই জেরে বৃহস্পতিবার রাতে একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেছিলেন, “রাজ্য সরকার রুশদিকে শুধু তাঁর সফর বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিল। নেহাতই বন্ধুর মতো পরামর্শ। রাজ্য সরকার রুশদিকে আসতে নিষেধ করেনি।” সৌগতবাবুর কথার প্রতিবাদ করেও এ দিন টুইট করেছেন রুশদি। লিখেছেন, “তাজ্জব কথা, সৌগত রায়! আমাকে আদৌ কোনও ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ’ দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, নামামাত্র পুলিশ আমাকে পরের বিমানে তুলে পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়ে দেবে।” সৌগত রায় তার উত্তরে বলেন, “আমার যা বলার তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে রুশদি যা বলার, বলেছেন। আমি আর কিছু বলব না।”
রুশদি বাস্তবিকই আরও অনেক কিছু বলেছেন। অভিযোগ করেছেন, পুলিশই আগেভাগে তাঁর সফরসূচি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে চেয়েছিল। এবং সেটা প্রশাসনের বৃহত্তর পরিকল্পনার অঙ্গ বলেই মনে করছেন রুশদি। তাঁর কথায়, “কলকাতায় আমার সম্ভাব্য গতিবিধির বিশদ বিবরণ পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেয় কোন উড়ানে আমি যাব, কোথায় থাকব, কখন লিটারারি মিট-এ যাব, কোন উড়ানে ফিরব। অর্থাৎ ঝামেলাবাজদের স্পষ্ট আমন্ত্রণ জানানো হল, যাতে ওরা ওদের যা খুশি করতে পারে। সেই মতো শ’খানেক লোক বিমানবন্দরে জড়ো হয়েও গেল। ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, এ সব কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনাতেই হয়েছে।”
ঘটনাচক্রে মহাকরণের মতোই কলকাতা পুলিশও রুশদির অভিযোগের উত্তরে নীরব থেকেছে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা কিংবা সরকারি ভাবে বাহিনীর যিনি মুখপাত্র, সেই যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে কলকাতা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, পুলিশ রুশদির সফরসূচি ফাঁস করেনি। রুশদির কলকাতায় আসার কথা ছিল বুধবার। কিন্তু তার দিন চারেক আগে একটি উর্দু সংবাদপত্রে বিতর্কিত ওই লেখকের সম্ভাব্য সফরসূচি বেরিয়ে যায়। সূত্রটির দাবি, সেখান থেকেই কয়েকটি সংখ্যালঘু সংগঠন বিষয়টি জানতে পেরে রুশদির আসা নিয়ে আপত্তি তোলে ও বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেয়। সেই খবর যায় সরকারের কাছে।
লালবাজারেরই একটি সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে সরকারের একেবারে শীর্ষস্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রুশদির কলকাতায় আসা যেনতেন প্রকারেণ ঠেকাতে হবে। লালবাজার সেই নির্দেশ পালন করে মাত্র। পুলিশের উদ্যোগে এক জন মধ্যস্থতাকারী রুশদির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে জানান, তিনি কলকাতায় কাঙ্ক্ষিত নন। কারণ তিনি কলকাতায় পৌঁছনো মাত্র তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হবে। ওই মধ্যস্থতাকারী মারফত কলকাতা পুলিশ বইমেলার আয়োজকদের একটি লিখিত বিবৃতিও রুশদিকে পাঠিয়েছিল, যেখানে জানানো হয়, রুশদি আদৌ বইমেলায় আমন্ত্রিত নন।
সূত্রে খবর, এর পরে মঙ্গলবার গভীর রাতে রাজ্য প্রশাসন জানতে পারে, রুশদি শেষমেশ তাঁর কলকাতা সফর বাতিল করেছেন। তার আগে অবধি সরকার নিশ্চিত ছিল না, রুশদি নিষেধ না মেনে এসে পড়বেন কি না। মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদও তাই লালবাজার থেকে আলিপুর-সহ কয়েকটি থানায় রুশদির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল। লালবাজারের কর্তারা ঠিক করেছিলেন, রুশদি যেখানে থাকবেন, আলিপুরের সেই পাঁচতারা হোটেলে পুলিশ থাকবে সাদা পোশাকে। এর পাশাপাশি, প্রয়োজনে যাতে তাড়াতাড়ি অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো যায়, সে জন্য আলিপুর থানায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলেও ঠিক ছিল।
পুলিশের পক্ষ থেকে রুশদির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন? রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তবে মহাকরণের একটি সূত্রের খবর, পরিচালক দীপা মেটার যে-ছবির প্রচারের জন্য রুশদির কলকাতায় আসার কথা ছিল, সেই ছবির পরিবেশক সংস্থার কাউকে দিয়েই যোগাযোগ করানো হয়েছিল।
বইমেলা এবং লিটারারি মিট-এর আয়োজকদের ভূমিকা এখানে কী? পুলিশের কথা মতো, বইমেলার আয়োজকরা বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, রুশদি বইমেলায় আমন্ত্রিত নন। কিন্তু তাঁর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রুশদি লিখেছেন, “বুধবার কলকাতা লিট মিটের একটি অনুষ্ঠানে দীপা মেটা, রাহুল বসু ও রুচির জোশীর সঙ্গে আমারও বক্তা হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। আয়োজকরা তার সবটাই জানতেন। ওঁরাই আমাকে ‘সারপ্রাইজ গেস্ট’ হতে বলেছিলেন। এখন যদি ওঁরা সেটা অস্বীকার করেন, তা হলে সেটা অসততা। ওঁরা আমার উড়ানের টিকিটের দামও দিয়েছিলেন।” আগের দিন দীপা মেটা-ও একই দাবি করেছিলেন টুইটে। কিন্তু লিটারারি মিট-এর আয়োজক মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রুশদির টিকিট কাটার কথা অস্বীকার করেন। তবে রুশদি আমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেনই না, এমন কথা তিনি বৃহস্পতিবার সরাসরি বলেননি। এ দিন কিন্তু তিনি দাবি করছেন, রুশদি আমন্ত্রিত ছিলেন না। তার পরই টুইটে রুশদি ফের বলেন, “লিটারারি মিট-এর আয়োজকরা যখন বলছেন ওঁরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাননি, তাঁরা মিথ্যে কথা বলছেন। আমার কাছে তাঁদের পাঠানো ই-মেল এবং বিমানের টিকিট রয়েছে।” তখন ফের মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমার এই ব্যাপারে কিছুই বলার নেই।” ‘কিছুই বলতে না চাওয়া’র দলে এ দিন গোড়া থেকেই ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল দু’জন। প্রথম জন বইমেলার সংগঠক ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’-এর সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, “রুশদি নির্ভেজাল মিথ্যে বলছেন। আমরা কিংবা কলকাতা লিট মিটের উদ্যোক্তারা, কেউই রুশদিকে আমন্ত্রণ জানাইনি। রুশদির কাছে আমন্ত্রণপত্র দেখতে চাওয়া হোক।”
দ্বিতীয় জন, শাসক দলের সাংসদ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদ। রুশদিকে কলকাতায় আসতে না-দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে রুশদিকে ‘শয়তান’ ও ‘ইসলাম-বিরোধী’ বলে তকমা দিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি, সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ছিছিক্কার পড়ে গিয়েছে। বহু বিশিষ্ট জন এই ঘটনাকে লেখক-শিল্পীর কণ্ঠরোধ ও স্বাধীনতা হরণ বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে গোটা দেশের সঙ্গেই শুক্রবারই এ রাজ্যেও রুশদির বুকার-জয়ী উপন্যাস অবসম্বনে তৈরি ছবি ‘মিডনাইটসচিলড্রেন’ মুক্তি পেয়েছে। দিল্লি, বেঙ্গালুরু ও মুম্বইয়ে ছবির প্রচার সেরে এ দিন ভারত ছাড়লেন রুশদি। তাঁর সঙ্গে রইল একটা দুঃখ যে, নিজের জন্মভূমিতে স্বাধীন ভাবে চলাফেরার অধিকার তাঁর নেই।
|
|
সরল সত্যটা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে পুলিশ আমাকে আটকে দেয়। |
যে দিন কলকাতায় যাওয়ার কথা, তার আগের দিন বলা হল, কলকাতা পুলিশ আমাকে আটকাবে। এ-ও বলা হল, এ সবই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। |
গত বার জয়পুর সাহিত্য উৎসবের পরই মমতা বলেন, উনি আমাকে কলকাতায় ঢুকতে দেবেন না। সেই হুমকিটাই কাজে পরিণত করলেন উনি। |
তাজ্জব কথা, সৌগত রায়! আমাকে আদৌ ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ’ দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, নামামাত্র আমাকে পত্রপাঠ ফেরত পাঠানো হবে। |
পুলিশ আমার সফরের খুঁটিনাটি সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছে এবং বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে। আমি ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, এগুলো কর্তৃপক্ষেরই পরিকল্পনামাফিক হয়েছে। |
লিটারারি মিট-এর আয়োজকরা যখন বলছেন আমি আমন্ত্রিত ছিলাম না, তাঁরা মিথ্যে বলছেন। আমার কাছে তাঁদের পাঠানো ই-মেল, বিমানের টিকিট আছে। |
মকবুল ফিদা হুসেন, রোহিনটন মিস্ত্রী, এ কে রামানুজন, জেমন লেইন, দীপা মেটা, আশিস নন্দী, কমলহাসন এবং আরও বাকিদের সঙ্গে যা হচ্ছে, তাকে আমি সাংস্কৃতিক জরুরি অবস্থা বলে মনে করি। |
|
মৃণাল সেন |
শুভাপ্রসন্ন |
তপন রায়চৌধুরী |
কোন দেশে বাস করছি? এটা কি কলকাতা? যে শহরটাকে এত ভালবাসি? এত অসভ্যতা, অভব্যতা ভাবাই যায় না। |
এক জন লেখকের এ শহরে আসার নিশ্চয়ই অধিকার আছে। কিন্তু তাতে যদি দাঙ্গা বাধার পরিস্থিতি হয়, রাজ্য তাঁকে ঢুকতে দেবে কেন?
|
লজ্জার ঘটনা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে রাষ্ট্র কোন পথে চলবে, তা ‘মব’ ঠিক করে।
|
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত |
নবনীতা দেবসেন |
রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না। এটুকুই বলব, এক জন লেখকের এ শহরে আসতে না পারাটা আমার কাছে খুব দুঃখের। খুব শকিং। |
রোগটা সারা দেশেরই, বিপদটাও সর্বজনীন। কারণ স্বল্পসংখ্যক দাঙ্গাবাজকে তুষ্ট রাখতে গিয়ে শাসকেরা যুক্তির প্রক্রিয়া বন্ধ রাখছেন। বিপন্ন হচ্ছে গণতন্ত্র।
|
তিনটে শহর পারল, কলকাতা পারল না। দুই সরকারের আমলে এ রকম দুটো ঘটনা ঘটল। আমাদের বোধ হয় নতুন করে ভাবা উচিত গোলমালটা কোথায়।
|
|