চিতাবাঘ থেকে মুখ্যমন্ত্রী, ঘাম ছুটল পুলিশের
লোকেশন..লোকেশন...?
নমস্কার স্যার। হাকিমপাড়ার অতুলপ্রসাদ সরণি। কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম থেকে দেড় কিমি। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর বাড়ি থেকে ১ কিমি। লোক চাই স্যার।
“আরও ফোর্স যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দরকারে লাঠি নিয়ে তাড়া করুন। কোনও ভাবেই মারবেন না”--নির্দেশ এল ওয়ারলেসে।

উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব
‘ডিজিট্যাল মুভি ক্যামেরা’র ফ্রেমে দেখলে মনে হবে ‘উপদ্রুত’ কাশ্মীরের কোনও এলাকার ছবি। যেখানে জঙ্গি ডেরা ঘিরে ফেলেছে নিরাপত্তা বাহিনী। এলাকার চার দিকে ফ্ল্যাট বাড়ি। মাঝে একতলা পাকা ও টিনের বাড়ি। সরু রাস্তা, গলিতে উৎসুক মানুষের কালো মাথা। সারি সারি পুলিশের গাড়ি। হ্যান্ডমাইকে পুলিশকর্মীরা বাসিন্দাদের আরও পিছনে চলে যেতে বারবার অনুরোধ করছেন।
সোমবার সকালে হাকিমপাড়ায় শান্তি মোড় লাগোয়া এলাকার এই দৃশ্য।
কে নেই সেখানে? রাইফেল, রিভলভারধারী পুলিশকর্মীরা চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। সঙ্গে এসএলআর নিয়ে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্সও। হেলমেট পরে ডার্ট-গান আর সিরিঞ্জ নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন বনকর্মীরাও। সকলের শরীরে লাইফ জ্যাকেট। অফিসারদের মোবাইল, ম্যানপ্যাক বেজেই চলছে। মানুষকে ফাঁকা করতে টানা বাজছে পুলিশ পাইলটের হুটারও। মনে হবে যখন তখন টিনের বাড়ি থেকে বার হতে আসতে পারে জঙ্গিরা। এর মধ্যেই নাইলনের মোটা নেট দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় গোটা বাড়ি। কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিলেন পুলিশ ও বন দফতরের শীর্ষকর্তারা। উদ্বেগে জনপ্রতিনিধি সুজয় ঘটকও। উৎসুক জনতাকে হটাতে দু’বার লাঠিচার্জও করতে হয়।
ইতিমধ্যে জাল ঘেরার ঘরের একটি জানলাও ভেঙে ফেলে ঘরের ভিতরে থাকা অনাহুত ‘অতিথি’। অন্য পাশের জানলায় বার তিনেক হানা দিয়েছে। লোহার বেড়ি টানা দরজা কোনওক্রমে আটকে রাখা হয়েছে। জানলার ফাঁকা দিয়ে দেখা গিয়েছে, গোটা ঘর ততক্ষণে তছনছ। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার বাসিন্দা ভিড় বাড়ির ছাদ, রেলিং, গাছের ডাল অবধি গড়িয়েছে। সোমবারের সকালের শিলিগুড়ির অতুলপ্রসাদ সরণির এমন হাল দেখে অনেকেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে নাজেহাল ৫০ জন পুলিশকর্মী।
কিন্তু সকালটা অন্য ভাবে শুরু হওয়ার কথা ছিল শিলিগুড়ি পুলিশের।
বেলা বাড়তেই শহরে পা রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাস্থল থেকে মেরেকেটে দেড় কিমির মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানস্থল শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। প্রায় একই দূরত্বে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের বাড়ি। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে এলাকায় আসেন গৌতমবাবুও। বাদ দেননি শহরের বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বাদ দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশার আভারু রবীন্দ্রনাথ, সহকারী পুলিশ কমিশনার প্রদীপ পাল, আইসি বিকাশকান্তি দে-সহ ১০ পুলিশ অফিসার পুলিশ অফিসার প্রায় ৪ ঘন্টা আটকে রইলেন হাকিমপাড়ায়। থাকলেন বৈকুন্ঠপুরের ডিএফও ধর্মদেব রাই-সহ বনকর্তারাও। শেষে বেলা ১টা নাগাদ ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু হয়ে ধরা পড়ে ‘অনাহুত অতিথি’ একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘ। ডার্ট-গান থেকে ছোড়া গুলি বাঁ পায়ে লেগে কাবু পুরুষ চিতাবাঘটিকে পাইলট দিয়ে হুটার বাজিয়ে রাস্তা খালি করে সুকনার পথে রওনা হন বনকর্মীরা। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বিপত্তি। ঘুম থেকে জেগে উঠে গাড়ির জানলার কাচ ভেঙে দেয় চিতাবাঘটি। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় গাড়িটি। বনকর্মীরা মাথায় বসে সেটিকে সুকনা ওয়াইল্ড লাইফ স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে খাঁচাবন্দি করে। ততক্ষণে সম্বিৎ ফিরেছে ‘শহর আতঙ্ক ধরানো’ চিতাবাঘটির। পশু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, সুস্থ রয়েছে সাড়ে ৩ ফুট উচ্চতার চিতাবাঘটি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, “এলাকাটি একেবারে বসতি এলাকা। প্রচুর মানুষ ছিল। আমরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি। কোনও ক্রমে ঘর থেকে জন্তুটি বার হলে বিপদ হতে পারত।” আর বৈকুন্ঠপুরের ডিএফও ধর্মদেব রাই বললেন, “চিতাবাঘটি সুস্থ আছে। ওর গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখছি। চিকিৎসকেরা নির্দেশ দিলেই চিতাবাঘটিকে জঙ্গলে ছাড়া হবে।”

আতঙ্কে শিলিগুড়ি
হিতেন বর্মন, বনমন্ত্রী
চিতাবাঘ কবে বের হবে সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বের হলেই বা কী করা যাবে। আমরা দেখি লোকালয়ে চিতাবাঘ ঢুকে পড়লে যেন সেখানে দ্রুত বনকর্মী পৌঁছতে পারে। শিলিগুড়িতেও সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চিতাবাঘটিকে ঘুমপাড়ানি গুলি করে সুকনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জখম এক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

বিপিন কুমার সুদ, উত্তরবঙ্গের বনপাল (বন্যপ্রাণ)
সুকনায় চিতাবাঘটিকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। পশু চিকিৎসকদের মতামত নিয়ে পরে সেটি জঙ্গলে ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চিতাটি মহানন্দার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোনও ভাবে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময়ে দুবার শিলিগুড়িতে চিতাবাঘ ঢুকে পড়ার বিষয়টি নেহাতই কাকতলীয়। কারণ, জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ বের হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়।
অনন্ত রায়, প্রাক্তন বনমন্ত্রী

যা ঘটছে তাতে বনরক্ষা থেকে জঙ্গলের খাদ্যশৃঙ্খল সবই ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
২০১১ সালেও তো মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময়ে শিলিগুড়ি শহরে চিতাবাঘ ঢুকে কয়েকজনকে
জখম করে। এবারও হল। হতে পারে ঘটনাগুলি কাকতালীয়। আবার প্রতীকীও হতে পারে।
পপ শেরিং ভুটিয়া, বনপাল নর্দান সার্কেল
এই সময় লোকালয়ে চিতাবাঘ ঢুকে পড়ার নির্দিষ্ট কোনও কারণ নেই। বিভিন্ন কারণে যেতে পারে। আগেও শহরে চিতাবাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এটা দুর্ঘটনা মাত্র।

শিলবন্ত সিংহ পটেল, মুখ্য বনপাল
এখন তো প্রজননের সময় নয়। তাই ওই কারণে চিতাটি লোকালয়ে ঢুকেছে এটা বলা যায় না। তবে খাবারের লোভে শহরে ঢুকতে পারে।
সুমিতা ঘটক, ডিএফও
বসতি এলাকা ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল। জঙ্গলের শান্ত পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ওই কারণে বন্যপ্রাণীও লোকালয়মুখী হচ্ছে।
অনিমেষ বসু, সম্পাদক, ন্যাফ
এখন প্রজননের সময়। অনিচ্ছুককে তাড়া করতে গিয়ে কুয়াশায় দিকভ্রষ্ট হয় পুরুষ চিতাবাঘ। চিতাবাঘের খাদ্য মানে পশু, হাঁস-মুরগি হাকিমপাড়ায় মেলা দুষ্কর। খাবারের জন্য ঢোকার কথা মানা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে প্রথমটিই কারণ।
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.