|
|
|
|
দিনদুপুরে শিলিগুড়ি দাপাল অন্য ভিআইপি |
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি |
বাঘের সঙ্গে কোথাও কি যোগ আছে তাঁর?
সেটা ছিল ২০১১ সালের ১৯ জুলাই। উত্তরবঙ্গ সফর সেরে রওনা দেবেন বলে তৈরি মুখ্যমন্ত্রী। আর শিলিগুড়ির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের লিম্বুবস্তিতে হানা দিল এক চিতাবাঘ।
তারই পুনরাবৃত্তি যেন এ দিন দেখল শিলিগুড়ি শহর। তফাত শুধু, এ দিন তিনি পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টা আগেই বাঘ পড়েছিল হাকিমপাড়ার অতুলপ্রসাদ সরণিতে।
সোমবার বিকেল ৩টে নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছন শিলিগুড়িতে। আর বেলা ৯টা নাগাদ শিলিগুড়ির অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত হাকিমপাড়ায় দেখা যায় পূর্ণবয়স্ক ওই চিতাবাঘটিকে। দু’জনকে জখমের পরে একটি বাড়িতে ঢুকে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে সে। তার পরে ঘুমপাড়ানি গুলি দিয়ে কব্জা করা হয় তাকে। তবে তা করতে করতে প্রায় ৪ ঘণ্টা গড়িয়ে যায়। ভয় আর উৎসাহ মিলেমিশে এই পুরো সময়টা জুড়ে উত্তেজনায় ফুটেছে গোটা এলাকা। তার মধ্যেই চলেছে প্রশাসন-পুলিশের দৌড়োদৌড়ি। শীতের সকালেও ঘাম ছুটে গিয়েছে তাঁদের। এমনকী, চিতাবাঘের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে ওই পাড়ায় হাজির হতে হয়েছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবকে। চলে আসেন বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যও। পুলিশের বড় কর্তারা বুঝে উঠতে পারছেন না তখন হাকিমপাড়া সামলাবেন, নাকি মমতার জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম ও সেই পর্যন্ত পথে পাহারা রাখবেন।
|
|
মমতার শিলিগুড়ি সফরের দিনেই শহর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াল
চিতাবাঘ। অবশেষে খাঁচাবন্দি সে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক |
তত ক্ষণে মুখ্যমন্ত্রী খবর পেয়ে গিয়েছেন চিতাবাঘ হানার। এর আগে ২০১১ সালে লিম্বুবস্তিতে চিতাবাঘ হানায় ৮ জন জখম হয়েছিলেন। সে দিন বাগডোগরা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনকে জখমদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে লোকালয়ে চিতাবাঘ কেন ঢুকছে, তা খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ দিন তিনি ফোন করেন গৌতম দেবকে।
হয়তো সমাপতন। তবে মমতার কথায় বাঘের প্রসঙ্গ বিভিন্ন সময়েই ঘুরেফিরে এসেছে। গত সেপ্টেম্বরে গাইঘাটায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “এটা জেনে রাখুন, যত দিন বাঁচব, বাঘের বাচ্চার মতো মাথা উঁচু করে বাঁচব।” আগে ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবন সফরে গিয়েও তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল একই কথা। তা ছাড়া, এই সে দিনও তিনি শিল্পী সমীর আইচ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বাঘের পালে যখন পড়বেন, বুঝতে পারবেন!”
এ দিনের ঘটনা সেই তালিকায় নতুন সংযোজন। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বলেছেন, এ সমাপতন ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে মুখ্যমন্ত্রীর সফর আর চিতাবাঘের উপদ্রবের যুগলবন্দিতে এ দিন সব থেকে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছে শহরের পুলিশ-প্রশাসনকে। কোনও ভাবে চিতাবাঘের হানায় বড় ক্ষয়ক্ষতি হলে উত্তরবঙ্গ উৎসব পণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তারা। শেষ পর্যন্ত জনতাকে বুঝিয়ে ভিড় কিছুটা সরানো হয়। তার পরে দু’দফায় লাঠি চালিয়ে কৌতূহলীদের নিরস্ত করে চিতাবাঘটিকে সুকনা রেসকিউ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ দিন কী ভাবে শহরে ঢুকল চিতাবাঘ?
পরিবেশপ্রেমীদের অনেকেরই মতে, উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা দিনের পর দিন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে দেখেও নজরদারি না-বাড়ানোয় চিতাবাঘের শহরে ঢুকে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। শিলিগুড়ির একটি পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মুখপাত্র অনিমেষ বসু দেড় বছর আগেকার মমতার নির্দেশের উল্লেখ করে বলেছেন, “শিলিগুড়ি লাগোয়া বৈকুণ্ঠপুর ও মহানন্দার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চিতাবাঘদের বিচরণ ক্ষেত্র নির্বিঘ্ন রাখার কথা তো মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন।” বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন অবশ্য মনে করেন, “বন লাগোয়া লোকালয়ে চিতাবাঘ ঢুকতেই পারে। চিতাবাঘের তো সময়জ্ঞান নেই। তাই কোনও বার্তা খোঁজা নিরর্থক। এটা রুখতে বন দফতর সব সময় সক্রিয়।”
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?
বেলা ৯টা নাগাদ একটি বেকারি লাগোয়া পাঁচিলের ধারে ঘাপটি মেরে থাকা জন্তুটি এক জনকে জখম করে বিদ্যুৎগতিতে কিছুটা দূরের আর একটি বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে। সেখানে এক মহিলাকে জখম করে ঘরে ঢুকে পড়ে। হইচই শুনে প্রতিবেশী এক যুবক নীতীশ ঘোষ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। কিন্তু, দরজায় কব্জা না-থাকায় উঠোনে পড়ে থাকা আঁশ বটি তলা দিয়ে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তা চেপে ধরে থাকেন। প্রায় এক ঘণ্টা ওই ভাবে বসে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে চিতাবাঘটি ঘরের যাবতীয় আসবাব লন্ডভন্ড করে। বন দফতর ও পুলিশ এসে গোটা ঘরটি জাল দিয়ে ঘিরে ফেলে। বেলা ১টা নাগাদ ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে চিতাবাঘটিকে কব্জা করে বন দফতর। পরে সেটিকে নিয়ে যাওয়া হয় সুকনার বন্যপ্রাণ উদ্ধার কেন্দ্রে। যাওয়ার পথেও
ঘুম ভেঙে গাড়ির আসন তছনছ করে দেয় চিতাবাঘটি।
শেষ অবধি সব ঠিকঠাক হওয়ায় উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্যোক্তারাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। উদ্যোক্তাদের কয়েক জন বলেন, “একে পাহাড়ে বিমল গুরুঙ্গ, তার উপরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর ঘরের দরজায় চিতাবাঘ। গুরুঙ্গ অবস্থান বদলেছেন। চিতাবাঘও ধরা পড়েছে। না হলে কী যে হতো!”
ভারতে যে সব বনাঞ্চলে চিতাবাঘ রয়েছে, প্রায় সর্বত্রই তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। লোকালয়ে ঢোকার ঘটনাও দেশের নানা প্রান্তে ঘটছে। গত
মে মাসে খাস মুম্বইয়ের শহরতলি মালাড এলাকায় চিত্রতারকা তথা সাংসদ হেমা মালিনীর বাংলোয় চিতাবাঘ ঢুকে পড়ে। তরাই-ডুয়ার্সের চা বাগান এলাকা চিতাবাঘের হানা এবং তাদের পিটিয়ে মারার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে।
এই প্রসঙ্গে পরিবেশপ্রেমীরা উল্লেখ করেছেন গুজরাতের একটি ঘটনা। গত অক্টোবরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘স্বামী বিবেকানন্দ যুব বিকাশ যাত্রা’কে স্বাগত জানিয়ে টাঙানো একটি হোর্ডিংয়ে ছিল পরপর চারটি চিতাবাঘের ছবি। তার মধ্যে একটি খাঁচায় বন্দি। পাশে বিজেপি-র সুরাত জেলা সভাপতি সুরেশ পটেলের ছবিও। ওই হোর্ডিংয়ে লেখা ছিল, ‘আমরা সুরাতের চিতাবাঘেরা মান্ডবীতে আপনার যাত্রাকে ঊষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। নরেন্দ্রভাই, আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য আপনার সাহায্য চাই।’ হোর্ডিংটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। বিড়ম্বনায় পড়েন সুরেশ পটেল। তিনি দলীয় পর্যায়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রসঙ্গত, মান্ডবীতে ২০১১ সালে চিতাবাঘের হানায় ১২ জনের মৃত্যু হয় ও ৬টি চিতাবাঘকে পিটিয়ে মারা হয়।
তা হলে শিলিগুড়িতে চিতাবাঘের হানাও কি কোনও বার্তা দিচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য চিতাবাঘের হানা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। সরকারি সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী লোকালয়ে হানা রুখতে দ্রুত পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “শীঘ্রই বনমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠকে বসব।” |
|
|
|
|
|